প্রিয় পাঠক, বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে দেশি বিদেশি সহ মোট ৫ প্রকার শব্দ নিয়ে। তবে বাংলা ভাষার শুরুর দিকে বাংলা এতো সমৃদ্ধ ছিলো না।
যেমন বাংলাদেশে তুর্কিদের আগমন এবং মুসলিম শাসন পত্তনের সুযোগে প্রচুর আরবি ও ফারসি ভাষা বাংলায় এসেছে।
এছাড়াও আমাদের অনেক নিজস্ব শব্দ তৈরি হয়েছে। কিংবা বিভিন্ন ভাষা থেকে হালকা পরিবর্তন হয়েও অনেক শব্দ ভাষায় এসেছে।
এভাবে বাংলা ভাষায় যে সকল শব্দের সমাবেশ ঘটেছে, সেগুলোকে পন্ডিতগণ প্রথমত ৫ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলোঃ
১। তৎসম শব্দ
২। তদ্ভব শব্দ
৩। অর্ধ-তৎসম শব্দ
৪। দেশি শব্দ
৫। বিদেশি শব্দ
আমরা এখন বিস্তারিতভাবে উদাহরণ সহ বাংলা ভাষার ৫ প্রকার শব্দ ভান্ডার আলোচনা করবো।
বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার আলোচনা:
১। তৎসম শব্দ:
তৎসম শব্দ বলতে সংস্কৃত শব্দের সমান বোঝানো হয়। যেমন, তৎ=তার এবং সম=সমান, অর্থাৎ সংস্কৃতর সমান।
সুতরাং যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে এবং যাদের রুপ অপরিবর্তিত আছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ।
কিছু তৎসম শব্দের উদাহরণঃ চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, পাত্র, ধর্ম, মনুষ্য ইত্যাদি।
২। তদ্ভব শব্দ:
যেসব শব্দের মূল সংষ্কৃত ভাষায় পাওয়া যায় কিন্তু, ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ।
তদ্ভব নিজেও একটি পারিভাষিক শব্দ। তদ্ভব এর অর্থ, “তৎ” (তার) থেকে “ভব” (উৎপন্ন) বা তার থেকে উৎপন্ন।
যেমনঃ সংস্কৃত=হস্ত, প্রাকৃত=হন্থ, তদ্ভব= হাত। আবার, সংস্কৃত=চর্মকার, প্রাকৃত=চম্মআর, তদ্ভব=চামার।
৩। অর্ধ-তৎসম শব্দ:
আমরা জানি অর্ধ কথার মানে হলো অর্ধেক। তৎসম মানে হলো সংস্কৃত। আর অর্ধ মানে হলো অর্ধেক। সুতরাং, অর্ধ-তৎসম মানে হলো আধা সংস্কৃত।
বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ সামান্য পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলোকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম শব্দ।
উদাহরণঃ “জ্যোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নী, বোষ্টম, কুচ্ছিত” নামক শব্দগুলো যথাক্রমে সংস্কৃত শব্দ “জ্যোৎস্না, শ্রাদ্ধ, গৃহিণী, বৈষ্ণব, কুৎসিত থেকে এসেছে”।
৪। বাংলা ভাষার দেশি শব্দ:
বাংলাদেশের আদিম অধিবাসী যেমন: কোল, মুন্ডা প্রভৃতি অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় এখনো রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দ বলা হয়।
অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না, তবে কোন ভাষা থেকে এসেছে, তার খোঁজ পাওয়া যায়।
যেমন: কুড়ি (বিশ) শব্দ কোল ভাষা থেকে এসেছে।
পেট (উদর) শব্দটি তামিল ভাষা থেকে এসেছে।
চুলা (উনুন) শব্দটি মুন্ডারি ভাষা থেকে এসেছে।
দেশি শব্দের আরো উদাহরণঃ কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ডাগর, ঢেঁকি ইত্যাদি।
৫। বাংলা ভাষার বিদেশি শব্দ সমূহ:
রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষীর নিকট থেকে বহু বিদেশি ভাষার শব্দ বাংলায় এসেছে। এসব শব্দকে বলা হয় বিদেশি শব্দ।
এসব শব্দের মধ্যে আরবী, ফারসি, ইংরেজি, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলান্দাজ, তুর্কি, বার্মা, চীনা, মালয়, জাপন ইত্যাদি ভাষার শব্দ উল্লেখ্যযোগ্য।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিদেশি শব্দ:
আরবি শব্দ:
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলোকে ২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো:
১। ধর্ম সংক্রান্ত আরবি শব্দ। যেমন: আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওজু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গোসল, জাহান্নাম, তওবা, তসবি, জাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল ইত্যাদি।
২। প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক আরবি শব্দ। যেমন: আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায় ইত্যাদি।
ফারসি শব্দ:
১। ধর্ম সংক্রান্ত ফারসি শব্দ: খোদা, গুনাহ, দোজখ, নামাজ, পয়গম্বর, ফেরেশতা, রোজা ইত্যাদি।
২। প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ফারসি শব্দ: কারখানা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশা, বেগম, বান্দা, মেথর, রসদ ইত্যাদি।
৩। বিবিধ ফারসি শব্দ: আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাস, রফতানি, হাঙ্গামা ইত্যাদি।
ইংরেজি শব্দ:
১। অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণের মতো: ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নোট, পাউডার, পেন্সিল, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, লাইব্রেরি, স্কুল ইত্যাদি।
২। পরিবর্তিত উচ্চারণে বাংলায় ব্যবহৃত কিছু ইংরেজি শব্দ সমূহ: আফিম (Opium), অফিস (Office), ইস্কুল (School), বাক্স (Box), হাসপাতাল (Hospital), বোতল (Bottle) ইত্যাদি।
পর্তুগিজ শব্দ:
আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি ইত্যাদি।
ফরাসি শব্দ:
কার্তুজ, কুপন, ডিপো, রেস্তোরাঁ, ইত্যাদি।
ওলান্দাজ শব্দ:
ইস্কাপন, টেককা, তুরুপ, রুইতন, হরতন ইত্যাদি।
গুজরাটি শব্দ:
খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি শব্দ:
চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দ:
চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা ইত্যাদি।
চিনা শব্দ:
চা চিনি ইত্যাদি।
মায়ানমার (বার্মিজ) শব্দ:
লুঙ্গি, ফুঙ্গি ইত্যাদি।
জাপানি শব্দ:
রিক্সা, হারিকিরি ইত্যাদি।
জার্মান শব্দ:
কিন্ডারগার্টেন।
ইতালি শব্দ:
ম্যালেরিয়া।
বাংলা ভাষায় কিছু মিশ্র শব্দ:
অনেক সময় দেশি ও বিদেশি শব্দ মিলে একটি শব্দের মতো শব্দদ্বৈত তৈরি করে। এসকল শব্দকে বলা হয় মিশ্র শব্দ।
কিছু মিশ্র শব্দের উদাহরণ:
রাজা-বাদশা = তৎসম + ফারসি শব্দ
হাট-বাজার = বাংলা + ফারসি শব্দ
হেড-মৌলভি = ইংরেজি + ফারসি শব্দ
হেড-পন্ডিত = ইংরেজি + তৎসম শব্দ
খ্রিষ্টাব্দ = ইংরেজি + তৎসম শব্দ
ডাক্তার-খানা = ইংরেজি + ফারসি শব্দ
পটেক-মার = ইংরেজি + বাংলা শব্দ
চৌ-হদ্দি = ফারসি + আরবি শব্দ
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কিছু পারিভাষিক শব্দ:
অম্লজান – oxygen
উদযান – hydrogen
নথি – file
প্রশিক্ষণ – training
ব্যবস্থাপক – manager
বেতার – radio
মহাব্যবস্থাপক – general manager
সচিব – secretary
স্নাতক – graduate
স্নাতকোত্তর – post graduate
সমাপ্তি – final
সাময়িকী – periodical
সমীকরণ – equation
কিছু প্রশ্ন-উত্তর:
তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি এই ৫ ভাগে বাংলা ভাষার শব্দকে ভাগ করা হয়েছে।
তদ্ভব শব্দ।
কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ঢেঁকি, ডাগর ইত্যাদি হলো দেশি শব্দ।
ফেরেশতা শব্দটি ফারসি ভাষার শব্দ।
- সোর্স – বাংলা ব্যাকরণ বই