বাংলা ব্যাকরণে ১৭ রকম ধ্বনির পরিবর্তন আলোচনা

প্রিয় পাঠক, নবম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণে ১৭ রকম ধ্বনির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, আজ আমরা এই টপিক নিয়ে আলোচনা করব।

বিসিএস সহ বিভিন্ন ধরনের চাকরির পরিক্ষায় ধ্বনির পরিবর্তন অংশ থেকে প্রশ্ন আসে।

এছাড়াও, ধ্বনির পরিবর্তনের কারণে ভাষারও পরিবর্তন ঘটে থাকে। এজন্য ধ্বনির পরিবর্তন জানতে হবে।

প্রিয় পাঠক, ভাষার পরিবর্তন, ব্যাকরণে ধ্বনির পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। তাহলে চলুন বাংলা ভাষার ধ্বনির পরিবর্তন জেনে নেয়া যাক।

বাংলা ব্যাকরণে ১৭ রকমের ধ্বনির পরিবর্তন কি কি:

১। আদি স্বরাগম:
উচ্চারণের সুবিধার জন্য বা অন্য কোনো কারণে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি এলে তাকে আদি স্বরাগম বলা হয়।

যেমন: স্কুল > ইস্কুল
স্টেশন > ইস্টিশন
স্তাবল > আস্তাবল
স্পর্ধা > আস্পর্ধা

২। মধ্য স্বরাগম, বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি:
সময় সময় উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি চলে এলে, তাকে মধ্য স্বরাগম বলা হয়। যেমন:

    • রত্ন > রতন
    • ধর্ম > ধরম
    • স্বপ্ন > স্বপন
    • হর্ষ > হরষ
    • প্রীতি > পিরীতি
    • ক্লিপ > কিলিপ
    • ফিল্ম > ফিলিম
    • মুক্ত > মুকুতা
    • তুর্ক > তুরুক
    • ভ্রু > ভুরু
    • গ্রাম > গেরাম
    • প্রেক > পেরেক
    • স্রেফ > সেরেফ
    • শ্লোক > শোলোক
    • মুরগ > মুরোগ > মোরগ

৩। অন্ত্যস্বরাগম:
কোনো কোনো সময় শব্দের শেষে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি এলে তাকে অন্ত্যস্বরাগম বলা হয়। যেমন:

দিশ্ > দিশা
পোখত্ > পোক্ত
বেঞ্চ > বেঞ্চি
সত্য > সত্যি

৪। অপিনিহিতি:
পরের ই কার আগে উচ্চারিত হলে কিংবা যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির আগে ই-কার বা উ-কার উচ্চারিত হলে তাকে অপিনিহিতি বলা হয়।

যেমন: আজি > আইজ
সাধু > সাউধু
রাখিয়া > রাইখ্যা
বাক্য > বাইক্য
সত্য > সইত্য
চারি > চাইর
মারি > মাইর

৫। অসমীকরণ:
একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে যখন স্বরধ্বনি যুক্ত হয়, তখন তাকে অসমীকরণ বলা হয়। যেমন:

ধপ + ধপ > ধপাধপ
টপ + টপ > টপাটপ

৬। স্বরসঙ্গতি বা Vowel Harmony:

একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দের অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বলা হয়। যেমন: দেশি > দিশি, বিলাতি > বিলিতি, মুলা > মুলো ইত্যাদি।

এই স্বরসঙ্গতি আবার ৫ ধরনের। এগুলো হলো:

  1. প্রগত: আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হলে তাকে প্রগত স্বরসঙ্গতি বলা হয়। যেমন: মুলা > মুলো, তুলা > তুলো, শিকা > শিকে
  2. পরাগত: অন্ত্যস্বরের কারণে আদ্যস্বর পরিবর্তিত হলে তাকে পরাগত স্বরসঙ্গতি বলা হয়। যেমন: আখো > আখুয়া > এখো, দেশি > দিশি
  3. মধ্যগত: আদ্যস্বর ও অন্তস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে তাকে মধ্যগত স্বরসঙ্গতি বলা হয়। যেমন: বিলাতি > বিলিতি
  4. অন্যোন্য: আদ্য ও অন্ত দুই স্বরই পরস্পর প্রভাবিত হলে তাকে অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি বলা হয়। যেমন: মোজা > মুজো
  5. চলিত বাংলায় স্বরসঙ্গতি: গিলা > গেলা, মিলামিশা > মেলামেশা, মিঠা > মিঠে, ইচ্ছা > ইচ্ছে ইত্যাদি। এছাড়াও এখানে, পূর্বস্বর উ-কার হলে পরবর্তী স্বর ও-কার হয়। যেমন: মুড়া > মুড়ো, চুলা > চুলো ইত্যাদি। বিশেষ কিছু নিয়ম রয়েছে, যেমন: উড়ুনি > উড়নি, এখনি > এখুনি ইত্যাদি।

৭। সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ:
দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত্য বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপকে সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ বলা হয়। যেমন: বসতি > বস্‌তি, জানালা > জান্লা

সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ ৩ প্রকার। এগুলো হলো:

  1. আদিস্বর লোপ: যেমন: অলাবু > লাবু > লাউ, উদ্ধার > উধার > ধার ইত্যাদি।
  2. মধ্যস্বর লোপ: যেমন: অগুরু > অগ্রু, সুবর্ণ > স্বর্ণ ইত্যাদি।
  3. অন্ত্যস্বর লোপ: আশা > আশ, আজি > আজ, চারি > চার (বাংলা), সন্ধ্যা >সঞঝা > সাঁঝ ইত্যাদি।

যেনে রাখা ভালো যে, স্বরলোপ আসলে স্বরাগমের বিপরীত প্রক্রিয়া।

৮। ধ্বনি বিপর্যয়:
শব্দের মধ্যে দুটি ব্যঞ্জনের পরস্পর পরিবর্তন ঘটলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলা হয়। যেমন: ইংরেজি বাক্‌স > বাংলা বাস্‌ক, জাপানি রিক্‌সা > বাংলা রিস্‌কা ইত্যাদি। অনুরুপ আরো রয়েছে, যেমন: পিশাচ > পিচাশ, লাফ > ফাল ইত্যাদি।

৯। সমীভবন:

শব্দমধ্যস্থ দুটি ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প-বিস্তর সমতা লাভ করে। এ ব্যাপারকে বলা হয় সমীভবন। যেমন: জন্ম > জম্ম, কাঁদনা > কান্না ইত্যাদি।

এই সমীভবন আবার মোট ৩ প্রকার।

  1. প্রগত সমীভবন: পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে বলা হয় প্রগত সমীভবন। অর্থাৎ এখানে পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনির মতো হয়। যেমন: চক্র> চক্‌ক, পক্ক > পক্‌ক, পদ্ম > পদ্দ, লগ্ন > লগ্‌গ ইত্যাদি।
  2. পরাগত সমীভবন: পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে, এটাকে পরাগত সমীভবন বলা হয়। যেমন: তৎ+জন্য > তজ্জন্য, তৎ+হিত > তদ্ধিত, উৎ+মুখ > উন্মুখ ইত্যাদি।
  3. অন্যোন্য সমীভবন: পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হলে তাকে অন্যোন্য সমীভবন বলা হয়। যেমন: সংস্কৃত সত্য > প্রাকৃত সচ্চ, সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা ইত্যাদি।

১০। বিষমীভবন:
দুইটি সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে বিষমীভবন বলা হয়। যেমন: শরীর > শরীল, লাল > নাল ইত্যাদি।

১১। দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা:
কখনো কখনো জোর দেয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়, এটাকে ব্যঞ্জনদ্বিত্বা বলা হয়। যেমন: পাকা > পাক্ক, সকাল > সক্কাল ইত্যাদি।

১২। ব্যঞ্জন বিকৃতি:
শব্দের মধ্যে কোনো কোনো সময় কোনো ব্যঞ্জন পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হলে তাকে ব্যঞ্জন বিকৃতি বলে। যেমন: কবাট > কপাট, ধোবা > ধোপা, ধাইমা > দাইমা ইত্যাদি।

১৩। ব্যঞ্জনচ্যুতি:
পাশাপাশি সমউচ্চারণের দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়। এরুপ লোপকে ধ্বনিচ্যুতি বা ব্যঞ্জনচ্যুতি বলা হয়। যেমন: বউদিদি > বউদি, বড়দাদা > বড়দা ইত্যাদি।

১৪। অন্তর্হতি:
পদের মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে তাকে অন্তর্হতি বলা হয়। যেমন: ফাল্গুন > ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি।

১৫। অভিশ্রুতির মাধ্যমে বাংলা ধ্বনির পরিবর্তন:

বিপর্যস্ত স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সাথে মিলে গেলে এবং তদনুসারে পরবর্তী স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে অভিশ্রুতি বলা হয়। যেমন: করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে “কইরিয়া” কিংবা বিপর্যয়ের ফলে “কইরা” থেকে অভিশ্রুতিজাত “করে”। এরুপ আরো হতে পারে। যেমন: শুনিয়া > শুনে, বলিয়া > বলে, হাটুয়া > হাউটা > হেটো, মছুয়া > মেছো ইত্যাদি।

১৬। র-কার লোপ:
আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন: তর্ক >তক্ক, করতে > কত্তে, মারলাম > মাল্লাম, মারল > মাল্ল, করলাম >কল্লাম ইত্যাদি।

১৭। হ-কার লোপ:
অধুনিক চলিত ভাষায় অনেক সময় দুই স্বরের মাঝামাঝি হ-কারের লোপ হয়। যেমন: পুরোহিত > পুরুত, গাহিল > গাইল, চাহে > চায়, সাধু > সাহু > সাউ, আরবি আল্লাহ > বাংলা আল্লা, ফরাসি শাহ্ > বাংলা শা ইত্যাদি।

অ-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি:
শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি থাকলে যদি এ দুটো স্বর মিলে একটি দ্বি স্বর না হয়, তবে এ স্বর দুটোর মধ্যে উচ্চারণের সুবিধার জন্য একটি ব্যঞ্জনধ্বনির মতো অন্তঃস্থ “য়” (Y) বা অন্তঃস্থ ব (W) উচ্চারিত হয়। এই অপ্রধান ব্যঞ্জনধ্বনিটিকে বলা হয় অ-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি।

যেমন: মা + আমার = মা (য়) আমার > মায়ামার
যা + আ = যা (ও) য়া = যাওয়া
এছাড়াও এরকম আরো আছে।
যেমন: নাওয়া, খাওয়া, দেওয়া ইত্যাদি।

বাংলা ধ্বনির পরিবর্তন বিষয়ে কিছু প্রশ্ন-উত্তর:

আলাবু > লাবু > লাউ, এটা কিসের উদাহরণ?

এটা সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপের উদাহরণ। এখানে আদিস্বরলোপ ঘটেছে।

অগুরু > অগ্রু, এখানে কোন ধরনের ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে?

এখানে মধ্যস্বরলোপ পেয়েছে।

‘কাদনা > কান্না’ এখানে কি ধরনের ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে?

এখানে সমীভবন ঘটেছে।

ক্লিপ > কিলিপ এখানে কোনে ধরনের ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে?

এখানে স্বরভক্তি ঘটেছে।

Leave a Comment