মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ ৮ম পর্ব

মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ শিরোনামের ধারাবাহিক ৮ম পর্ব বা ৩য় অধ্যায়ের ৪নং ক্লাসে আমরা যা যা আলোচনা করবো তা হলোঃ

  1. পশ্চাৎমস্তিষ্ক ও মধ্যমস্তিষ্কঃ প্রধান কার্যক্রম ও প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Hindbrain and Midbrain: Housekeeping Chores and Reflexes)
  2. অগ্রমস্তিষ্কঃ চেতনা, প্রেরণা, আবেগ ও ক্রিয়া (Forebrain: Cognition, Motivation, Emotion and Action)
  3. থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস ও লিম্বিক সিস্টেম (Thalamus, hypothalamus and Limbic System)
  4. সেরিব্রাল কর্টেক্সঃ সংবেদনশীল, জ্ঞানীয় এবং আজ্ঞাবাহী(মটর) কার্যক্রম (Cerebral Cortex: Sensory, cognitive and Motor Functions)
  5. সেরিব্রাল কর্টেক্সের অংশ বা ভাগ বা খন্ড (Lobes of the Cerebral Cortex)

মস্তিষ্ক(ব্রেইন) হচ্ছে মনোস্তাত্তিক (Psychological) জীবনের মৌলিক ভিত্তি। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ দ্বারা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত মানসিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মস্তিষ্কের একাধিক অংশের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয়।

কোনো কাজ মস্তিষ্কের মাত্র একটি অংশ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না।

মস্তিষ্ককে ৩টি প্রধান অংশে ভাগ করা হয়েছে:
১) অগ্রমস্তিষ্ক
২) মধ্যমস্তিষ্ক
৩) পশ্চাৎমস্তিষ্ক

এই প্রধান ভাগগুলোকে পরবর্তীতে আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ
চিত্র ১: মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ

পশ্চাৎমস্তিষ্ক ও মধ্যমস্তিষ্কঃ প্রধান কার্যক্রম ও প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Hindbrain and Midbrain: Housekeeping Chores and Reflexes):

পশ্চাৎমস্তিষ্ক হলো মস্তিষ্কের সবচেয়ে পেছনের অংশ যেটি করোটি/মাথার খুলির নিচের দিকে অবস্থিত। শরীলের যত নিয়মিত প্রধান কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রন করা পশ্চাৎমস্তিষ্কের প্রথমিক কাজ। মেডুলা, পনস্ এবং সেরিবেলাম হচ্ছে পশ্চাৎমস্তিষ্কের প্রধান ৩টি অংশ

মেডুলা হলো মস্তিষ্কের সবচেয়ে পেছনের অংশ অর্থাৎ মেরুরজ্জু (Spinal Cord) যেখান দিয়ে মস্তিষ্কের ভেতর প্রবেশ করেছে ঠিক তার উপরের অংশই হলো মেডুলা।

মেডুলা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাড়াভাবে দাড়ানোর জন্য বিভিন্ন অঙ্গের সক্ষমতা এবং প্রতিবর্তী ক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে।

মেডুলার ঠিক উপরেই পনস্ অবস্থিত। পনস্ দেহের ভারসাম্য, শ্রবণ এবং কিছু প্যারাসিম্প্যাথেটিক কাজ নিয়ন্ত্রন করে থাকে।

সেরিবেলাম গোলাকার দুটি খন্ডে গঠিত এবং পনসের ঠিক পৃষ্ঠভাগে অবস্থিত। জটিল অঙ্গ সঞ্চালনে এবং বিভিন্ন তথ্য জানা ও মনে রাখার মাধ্যমে যেখানে সমন্বয় সাধন হয়, সেখানে সেরিবেলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অসংখ্য নিউরন একত্রে রেটিকুলার ফরমেশন তৈরি করে যা মেডুলা ও পনসকে ছড়িয়ে দেয়! রেটিকুলার ফরমেশনকে একক স্নায়ুতন্ত্র মনে করা হলেও এটি আসলে অনেক স্নায়ুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত যা বিভিন্ন স্নায়ুতাড়না প্রবাহে ব্যবহৃত হয়।

রেটিকুলার ফরমেশনের এই বিভিন্ন অংশ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।

পশ্চাৎমস্তিষ্কের উপরে অল্প স্থানজুড়ে মধ্যমস্তিষ্ক অবস্থিত! ইন্দ্রিয়ের (senses) সাথে সম্পর্কিত এরুপ কাজ নিয়ন্ত্রনে মধ্যমস্তিষ্ক সাহায্য করে থাকে।

যেমন দর্শন (দেখা) এবং শ্রবণে রয়েছে মধ্যমস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

আবার মধ্যমস্তিষ্ক বিভিন্ন পেশীর সমন্বয়সাধন এবং ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে!

অগ্রমস্তিষ্কঃ চেতনা, প্রেরণা, আবেগ ও ক্রিয়া (Forebrain: Cognition, Motivation, Emotion and Action):

মনোবিজ্ঞানীদের কাছে ব্রেইন বা মস্তিষ্কের সবচাইতে আকর্ষনীয় অংশটি হলো অগ্রমস্তিষ্ক/Forebrain. কাঠামোগত দিক দিয়ে অগ্রমস্তিষ্ক ২ টি স্বতন্ত্র অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

এর মধ্যে ১টি অঞ্চলে থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস এবং বেশিরভাগ লিম্বিক সিস্টেম রয়েছে, যা পশ্চাৎমস্তিষ্ক ও মধ্যমস্তিষ্কের উপরে অবস্থি (চিত্র ১ এ দেখুন)

অন্য অঞ্চলটি সেরিব্রাল কর্টেক্স নিয়ে গঠিত। অগ্রমস্তিষ্ক/Forebrain এর এই ২টি অঞ্চল শুধু কাঠামোগত দিক দিয়েই ভিন্ন নয় বরং তাদের কার্যক্রমও ভিন্ন ভিন্ন।

থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস ও লিম্বিক সিস্টেম (Thalamus, hypothalamus and Limbic System):

দেহের সংবেদনশীল অঙ্গ থেকে আসা উদ্দীপনাকে মস্তিষ্কের যথাযথ স্থানে পাঠানো এবং এর সাথে মস্তিষ্কের উপরের এবং নিচের কেন্দ্রের সাথে সংযোগ করে দেয় থ্যালামাস।

সম্প্রতিক কালে একটি গবেষণার মাধ্যমে পরিষ্কার ভাবে জানা গেছে যে থ্যালামাস উপরের মস্তিষ্কের গঠনের সাথে আগত সংবেদনশীল তথ্যগুলি প্রক্রিয়াকরণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

হাইপোথ্যালামাস ক্ষুদ্র হলেও মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ! হাইপেথ্যালামাস, থ্যালামাসের নীচে ও মধ্যমস্তিষ্কের ঠিক সামনে অবস্থিত।

আমাদের উদ্দেশ্য এবং আবেগের (motives and emotions) সাথে হাইপোথ্যালামাস অন্তরঙ্গভাবে জড়িত।

এছাড়াও হাইপোথ্যালামাস শরীরের তাপমাত্রা, ঘুম, অন্তঃস্রাব গ্রন্থি ক্রিয়াকলাপ এবং রোগ প্রতিরোধের নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

এছাড়াও হাইপোথ্যালামাস পাকস্থলির এবং অন্ত্রের গ্রন্থি রস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপ এবং হার্টবিট হিসাবে শরীরের ক্রিয়াকলাপ গুলির স্বাভাবিক গতি এবং ছন্দ বজায় রাখতে সাহায্য করে

সুতরাং মস্তিষ্কের সয়ংক্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কাজের সাথে হাইপোথ্যালামাস সরাসরি যুক্ত।

লিম্বিক সিস্টেম ৩টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছে।

  1. অ্যামিগডালা (The amygdala): অ্যামিগডালা আবেগ এবং আগ্রাসনে মূল ভূমিকা পালন করে! এটি আবেগগতভাবে সৃষ্টি হওয়া ঘটনা (emotionally charged events) সম্পর্কে স্মৃতি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
  2. হিপ্পোক্যাম্পাস (The hippocampus): হিপ্পোক্যাম্পাস আবেগ সম্পর্কিত তথ্য প্রক্রিয়াকরণে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানীয় উপাদান নিয়ে আসে! নতুন স্মৃতি তৈরিতে হিপ্পোক্যাম্পাসও প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য; হিপ্পোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্থ হলে মানুষের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেতে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  3. সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (The cingulate cortex): সিঙ্গুলেট কর্টেক্স হিপ্পোক্যাম্পাসের সাথে আবেগ (emotion) সম্পর্কিত জ্ঞানীয় তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে কাজ করে থাকে।

সেরিব্রাল কর্টেক্সঃ সংবেদনশীল, জ্ঞানীয় এবং আজ্ঞাবাহী (মটর) কার্যক্রম (Cerebral Cortex: Sensory, cognitive and Motor Functions):

কর্টেক্স শব্দের অর্থ হলো “ছাল বা চমড়া”। অগ্রমস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ হলো সেরিব্রাল কর্টেক্সসেরিব্রাল কর্টেক্সের অনেক বিষয়ের সাথে যুক্ত, যেমন: সচেতন অভিজ্ঞতা, স্বেচ্ছাসেবী ক্রিয়াকলাপ, ভাষাজ্ঞান, বুদ্ধি ইত্যাদি যা কিনা আমাদের মানুষ হিসেবে তৈরি করেছে।

এর উপরের বা বাহিরের পাতলা অংশটি কয়েক মিলিয়ন নিউরনের ঘন আবরনে তৈরি হয়েছে।

তাই কোষ দেহের রং অনুুসারে এর বাহিরের রং হয়েছে ধূসর যা গ্রে ম্যাটার (gray matter) নামে পরিচিত।

অপর দিকে কর্টেক্সের নীচে সেরিব্রামের অঞ্চলটিকে সাদা পদার্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

কারণ এটি মূলত কর্টিকাল নিউরনের অক্ষের সমন্বয়ে গঠিত। এই নিউরনগুলির ফ্যাটযুক্ত মেলিনের প্রলেপের কারণে এদের সাদা দেখায়।

যা হোয়াইট ম্যাটার (white matter) নামে পরিচেত।

সেরিব্রাল কর্টেক্সের অংশ বা ভাগ বা খন্ড (Lobes of the Cerebral Cortex):

মানুষের মনস্তাত্ত্বিক কার্যক্রমে সেরিব্রাল কর্টেক্সের অনেক গুরুত্বের কারণে সেরিব্রাল কর্টেক্সের আরও বিস্তারিত জানার প্রয়োজন রয়েছে।

সেরিব্রাল কর্টেক্সের চার টি ভাগ বা লব (lobes) রয়েছে। ৪ টি ভাগ হলোঃ

  1. ফ্রন্টাল লব (Frontal Lobes):
    ফ্রন্টাল লব আমাদের কপালের পিছনের মাথার খুলির অংশ থেকে মাথার মাঝখানে পর্যন্ত প্রসারিত! এটি আমাদের চিন্তা ভাবনায় মূল ভূমিকা পালন করে। এছাড়া মনে রাখা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, কথা বলা ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা, ক্রিয়াকলাপ, চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং সংবেদনগুলি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
  2. প্যারিয়েটাল লোব (Parietal Lobes):
    মাথার ফ্রন্টাল লোবের ঠিক পেছনেই প্যারিয়েটাল লোব (Parietal Lobes) অবস্থিত। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন; হাত-পা কি করছে তা প্যারিয়েটাল লোব বুঝতে পারে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
  3. টেম্পোরাল লোব (Temporal Lobes):
    ফ্রন্টাল ও প্যারিয়েটাল লোবের নীচে মস্তিষ্কের গোড়ার মাঝে টেম্পোরাল লোব (Temporal Lobes) অবস্থিত। অর্থাৎ এটি কানের কাছে ও মাথার খুলির ভিতর অবস্থিত। এটি কানের কাছে অবস্থিত হওয়ায় টেম্পোরাল লোব (Temporal Lobes) শ্রবণ বা শব্দ শোনার কাজের সাথে জড়িত।
  4. অকসিপিটাল লোব (Occipital Lobes):
    অকসিপিটাল লোবগুলি মাথার পিছনের গোড়ায় অবস্থিত। এটি চোখের মাধ্যমে তথ্য নিয়ে তা বিশ্লেষন করে।

উপরের আলোচনায় আমরা মানুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করেছি। পারের অংশ পড়ুন। ধন্যবাদ।

Leave a Comment