চাইনিজ দর্শনে তাওবাদ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাওবাদের জনক হলেন লাওৎসে। আজ আমরা তাওবাদ ও লাওৎসের দর্শন আলোচনা করবো।
- তাওবাদের জনক লাওৎসে
- লাওৎসের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৭-৫১৭
- লাওৎসে নৈতিক দর্শনে গুরুত্ব দেন
- তাও মানে হলো- পথ বা উপায়
- লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবে তাওকে গ্রহণ করা হয়েছে
- ইন এবং ইয়াং হলো তাওবাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়
প্রাচীন চীনে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, যেন সমাজ থেকে এ নির্বাসিত এক সর্বব্যাপী হতাশা চীনের লােকদের আবৃত করে রেখেছিল।
এমনকি সামাজিক পরিমণ্ডলে চৈনিকরা সমাজে ঐক্য, স্থিতিশীলতা, শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য; সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের উন্নতির জন্য কতকগুলাে নিতিমালা প্রচার শুরু করেন।
চৈনিক যুগে অসংখ্য দর্শন ও দার্শনিকের আবির্ভাব হতে থাকে এবং এদের সমষ্টিগত নাম ছিল ‘The Hundred Schools of Philosophy’.
তখন জন্ম নিয়েছিলেন অসংখ্য ধর্ম দার্শনিক। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন লাওৎসে, যার মতবাদ তাওবাদ নামে পরিচিত।
লাওৎসের সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
লাওৎসে ছিলেন মূলত কনফুসিয়াসে সমসাময়িক। তার জীবনকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়; তিনি (খ্রিস্টপূর্ব ৬০৭-৫১৭ অব্দ) পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ছিলেন রাজকীয় গ্রন্থাগারের অধ্যক্ষ।
শিষ্যের অনুরােধে রাজ্য ত্যাগের পূর্বে লাওৎসে একটি বই লিখে যান; যার নাম তাও তি কিং’ (Tao Te King) যার অর্থ ধর্মপথ।
এটি দু’খণ্ডে বিভক্ত এবং পাঁচ হাজার শব্দ সংবলিত গ্রন্থ। এটির প্রথম খণ্ডের নাম তাও গ্রন্থ (Book at Tao) এবং দ্বিতীয় খণ্ডের নাম ‘তি’ (Book at Ti) গ্রন্থ।
বইটি মূলত দার্শনিক গ্রন্থ এবং এটি দুর্বোধ্য, পরস্পরবিরােধী ও পরিহাসে পরিপূর্ণ। তার গ্রন্থে দার্শনিক কনফুসিয়াসের পাণ্ডিত্যকে কটাক্ষ করা হয়েছে, আবার, প্রাকৃতিক জগতের প্রশংসাসহ মানুষের চেষ্টাকে অবাস্তব, অর্থহীন বলা হয়েছে।
লাওৎসে তার বই লেখার পর কোথায় চলে যান এবং তার পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি। সবকিছুই রহস্যে পরিপূর্ণ।
তাওবাদ কি ও কাকে বলে ?
লাওৎসে তার বইতে যে শিক্ষা দিয়ে যান, তার মূল বক্তব্য ছিল তাও এবং তার প্রচারিত মতবাদ ‘তাওবাদ’ নামে পরিচিত! তাও এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ।
তাওবাদের মূল বিষয় হচ্ছে জীবন পদ্ধতির জ্ঞানগত অতীন্দ্রিয়বাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তার লিখিত গ্রন্থ তাওতিকিং এ উল্লেখ আছে যে, তাওবাদ এমন একটি ধারণা, যার কোন আকার আয়তন, শব্দ কিংবা পরিবর্তন নেই এবং তা স্বর্গ ও মর্তে সর্বত্র বিরাজ করে।
তাও কে আমরা চিনি না, জানি না কিন্তু একে বলি তাও। তাও তত্ত্বের শিক্ষা হচ্ছে আভিমান বর্জন, পরার্থপরতা প্রভৃতি।
তাও এর বাণী হচ্ছে, “ঘৃণার প্রতিদান দাও দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করে এবং প্রেম আক্রমণে চিরজয়ী, প্রতিরােধ দুর্ভেদ্য।মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম অহিংসা, শক্ৰমিত্রে সমদৃষ্টি, যুদ্ধ ও যােদ্ধার নিন্দা করা।”
নিম্নে তাওবাদী দার্শনিক মতবাদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আলােচনা করা হলাে।
তাওবাদে ইন (Yin) ও ইয়াং (Yang):
ইন এবং ইয়াং এই ২ টি চৈনিক শব্দ। এই ইন এবং ইয়াং কে ভালো ভাবে না বুঝলে তাওবাদ ভালো ভাবে বোঝা যাবে না।
ইন কে অনেক টা নেগেটিভ এবং ইয়াং কে পজেটিভ অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে ইন এবং ইয়ান একদম পরস্পর বিরোধী নয়।
আমরা সহজ ভাষায় বলতে পারি সকল শুভ ও ভালোকে ইয়াং দ্বারা বোঝা যায়। অপরদিকে সকল মন্দকে ইন দ্বারা বোঝা যায়।
যেমন অন্ধকার আছে বলেই আমরা আলোকে বুঝি। অসুন্দর আছে বলেই আমরা সুন্দরকে বুঝি।
তাই- সুন্দর-অসুন্দর, আলো-অন্ধকার, উঁচু-নিচু, একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করে। সুতরাং- ইয়াং এবং ইন এর মধ্যে অভিন্ন সম্পর্ক করেছে।
প্রকৃতপক্ষে ইয়াং এবং ইন হলো একে অন্যর পরিপূর্ক। অনুরুপ ভাবে জগতের সব কিছুই ইয়াং এবং ইন এর বাহিরে নয়।
নিচের ছকে ইয়াং Yang এবং ইন (Yin) এর কিছু প্রকাশ দেয়া হলোঃ
Yang | Yin |
---|---|
Male energy | Female energy |
active | passive |
bright | dark |
heat | cold |
dry | moist |
fire | water |
light | dark |
sun | moon |
spring-summer | autumn-winter |
south | north |
heaven | earth |
male | female |
motion | rest |
life | death |
full | empty |
straight | crooked |
hard | soft |
round | square |
left | right |
long | short |
তাওবাদে ইয়াং এবং ইন এর মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ন অবস্থার সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। (Yin and Yang create each other).
ইয়াং ছাড়া ইন এর অস্তিত্ব থাকে না, আবার ইন ছাড়াও ইয়াং এর অবস্থান নির্দিষ্ট হয় না। সুতরাং ইন এবং ইয়াং পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।
Yin কে মূলত সেড বা ছায়া দ্বারা আবৃত আকারে প্রকাশ করা হয় এবং অন্ধকার, লুকানো, গোপন, শীতল ইত্যাদি শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে।
অপরদিকে Yang কে উজ্জ্বল, আলো, খোলা ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়।
ইয়াং এবং ইন:
যৌ*ন*তার ধারণাটি ইন এবং ইয়াং এর দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়। যেমন:
*পুরুষ উন্মুক্ত, সক্রিয়, আক্রমণাত্মক.. এইভাবে ইয়াং।
*মহিলা লুকানো, নিষ্ক্রিয়, ফলদায়ক… এইভাবে ইন।
কেউ কেউ ইনকে খারাপ এবং ইয়াং কে ভাল হিসাবে বিবেচনা করতে পারে। তবে মূলত এটি আসলে এমন নয়।
নিচের ছবিটি থেকে ইন ও ইয়াং এর ধারণা আরো পরিষ্কার হবে:
সমগ্র ব্যবস্থাটিই ভালো কারণ এটি সকল শুভ পথ এবং পৃথিবীর সঠিক শৃঙ্খলা।
কারণ যেখানে ইন এবং ইয়াং এর শক্তি ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে সেটা সবার জন্য, শুভ, স্বাস্থ্যকর আর মঙ্গলময় হবে।
তাওবাদ ও লাওৎসের সমাজ দর্শন:
লাওৎসের সামাজিক দর্শনের বক্তব্য হচ্ছে পথিবীর ন্যায়নীতির সাথে মানুষের ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা।
প্রজ্ঞার দ্বারা একটি আদর্শ সমাজ গঠনই ছিল লাওৎসের চিন্তাচেতনা।
এরূপ সমাজ গঠন সম্ভবপর হবে বিশৃঙ্খল ও নৈতিক অবক্ষয়যুক্ত সমাজ থেকে দূরে সরে নির্জনের জীবনযাপন দ্বারা।
লাওৎসের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের উচিত প্রকৃতিকে তার আপন গতিতে চলতে দেয়া এবং মানুষকে প্রকতির সাথে খাপ খাওয়ানাে, যার দ্বারা জীবনের স্বার্থকতা আসবে।
একজন তাওবাদী বিধিবদ্ধ সমাজ কাঠামাে থেকে দূরে সরে যেতে চায় এবং সমাজের উচ্চশ্রেণী দ্বারা অনুষ্ঠিত আচার-অনুষ্ঠান বর্জন করে থাকতে চায়।
সুতরাং এ দ্বারা বুঝা যায় যে, তাওবাদীরা আদিম সমাজে ফিরে যেতে আগ্রহী।
তাওবাদ ও লাওৎসের শিক্ষা দর্শন:
তাওবাদী লাওৎসের শিক্ষা দর্শন ছিল, “শিক্ষা মানুষকে চৌর্যবৃত্তিতে সাহায্য করে। লাওৎসের মতে, যারা শিক্ষিত হয়ে শিক্ষা দান করে, তারা কিছু জানে না আর যারা জানে তারা শিক্ষা দান করে না।
তাই তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানকে পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন যাতে মানবজাতির উপকার হয়। তাঁর ভাষায়; একজন সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ সে, যিনি মিতব্যয়ী ও নিরহংকারী।
যে যত বেশি অন্যের জন্য ব্যয় করবে, সে তত বেশি নিজের জন্য পাবে। লাওৎসের শিক্ষা ছিল বিশ্বজনীন শান্তিবাদ। লাওৎসের শিক্ষা বিষয় উপদেশসমূহের মধ্যে উল্লেখযােগ্য
- বিশ্বজনীন শান্তিবাদ অর্থাৎ প্রতিশােধপরায়ণ না হওয়া।
- প্রেমপ্রীতি দ্বারা মানব সম্পর্ক স্থাপন।
- সাম্যবাদ নীতি।
- যার আছে তার কাছ থেকে অন্যকে দান করা।
- মিতব্যয়ী ও অহংকারমুক্ত হওয়া।
তাওবাদ ও লাওৎসের রাষ্ট্র দর্শন:
লাওৎসের তাওবাদী মতবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্রদর্শনের শিক্ষা। তার মতে, রাজ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে এবং বিশৃঙ্খলার সষ্টি করে।
ফলে রাজ্যে অশান্তি বিরাজ করে। লাওৎসের মতে, রাষ্ট্র দর্শনে কিছু অবাধ নীতি হওয়া উচিত। তাঁর রাষ্ট্র দর্শন হচ্ছেঃ
- মানুষকে তার বিবেকবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে দিতে হবে।
- স্বাভাবিকভাবে একে অন্যের সাথে বসবাস করবে।
- সমাজে যত বাধানিষেধ থাকবে, প্রজারা ততই নিঃস্ব ও বিরক্ত হবে। তাই বাধানিষেধ থাকবে না।
- যত অস্ত্র তত বিশৃঙ্খলা। তাই অস্ত্র প্রদর্শন কমাতে হবে।
- প্রশাসনিক ব্যাপারে রাজার হস্তক্ষেপ কম হবে।
- শাসকশ্রেণী চারভাগে বিভক্ত।
- ক. সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক যার অস্তিত্বটুকুই মানুষ জানে।
- খ. সুশাসক যিনি প্রজার শ্রদ্ধা অর্জনে সফল।
- গ. অত্যাচারিত শাসক যার ভয়ে প্রজারা কম্পিত।
- ঘ. নিন্দিত শাসক যাকে প্রজারা সর্বক্ষণ নিন্দা করে।
- রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজতন্ত্র বহাল থাকবে। তবে তিনি হবেন জ্ঞানী ও সদাশয় রাজা।
- সরকারের মূলনীতি হবে প্রজার কল্যাণ করা।
তাওবাদ ও লাওৎসের দর্শনের প্রভাব:
লাওৎসে যে ধর্ম শিক্ষা প্রচার করেন তা মূলত তাওবাদী নামে খ্যাত। যদিও তিনি নিজে ধর্মপ্রচার করেন নি; কারণ তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। তথাপিও তাওবাদী ধর্ম প্রাচীন চীনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
যদিও প্রথমে তাওবাদী কোন ধর্মীয় আকার লাভ করে নি, তবে পরবর্তীকালে তাও দর্শন ধর্মের আকার লাভ করে।
এর ফলে তাওবাদীদের মধ্যে মন্দির, যাজক ও কুসংস্কার প্রথার প্রচলন হয়।
চীন বংশের কোন এক সম্রাট তাও তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন সভাসদবর্গের কাছে তখন কেউ হাই তুললে তাকে ঘাতকের হাতে তুলে দেয়া হতাে।
সেই আমলের শাসকগণ শক্তি অর্জন করার জন্য পন্থারূপে তাওবাদ সাধনা করতেন।
পরবর্তীকালে তাওধর্ম কৃষক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক শােষণের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজে একতা স্থাপন করে তাওধর্ম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাংজিয়াও নামক তাওবাদী ধর্ম নেতার নেতৃত্বে হ্যান রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সফলতা পায়।
তাও মতবাদ যখন চীনে একটি বিখ্যাত ধর্মরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে সে ধর্মের সাথে তাও তে কিং এর প্রস্তাবিত মূলনীতির সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না।
তাই এ সময় বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে তাওবাদের অবক্ষয় নেমে আসে।
প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় দার্শনিক লাওৎসে ছিলেন এক সত্যবাদী ও ন্যায়বাদী দার্শনিক! তিনি যে ধর্মমত বিষয়ক দার্শনিক গ্রন্থ লিখে গেছেন, তাই তাওবাদী।
মতবাদ নামে প্রচারিত হয় এবং চীনের সমাজ, শিক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
যদিও তাঁর বক্তব্য সমালােচিত হয়েছে, তথাপিও তাঁর মতবাদ চীনের রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।