নগর বিপ্লব কাকে বলে ও নগরায়নের প্রেক্ষাপট বিস্তারিত আলোচনা

প্রিয় পাঠক, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের আজকের পোষ্টে আমরা- নগর বিপ্লব কি ও নগর বিপ্লব কাকে বলে ? এবং নগরায়ন এর প্রেক্ষাপট আলোচনা করবো।

প্রাচীন মানব সভ্যতার ইতিহাসে নগরীর উত্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। পাথরের যুগের শেষ দিকে মানুষ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সাধন করে।

যার ফলে গ্রাম সমাজ থেকে নগরকেন্দ্রিক সমাজে উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল! এ নগরীর উত্থান হয়েছিল সুপ্ত ঐতিহাসিক যুগে। ইতিহাসে নগরীর উত্থান বা বিপ্লব হঠাৎ সংঘটিত হয়নি।

মূলত কৃষির আবিষ্কার ও বাণিজ্য নগরের উত্থানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

নগর বিপ্লব কাকে বলে:

নগর বিপ্লব শব্দটি ইংরেজি আরবান রেভ্যুলেশন (Urban Revolution) শব্দের প্রতিশব্দ! এ নগর বিপ্লব বা আরবান রেভ্যুলেশন শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন গর্ডন চাইল্ড।

নগর বিপ্লব সভ্যতা ও সমাজের বিবর্তনের ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপের সংযোজন করে। তবে বিপ্লব শব্দটি কে এখানে ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া বা দ্রুত সংগঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে না। এখানে কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মানবসম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক কাঠামো ও সংগঠনের প্রগতিশীল পরিবর্তনের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকে নগর বিপ্লব বলা হয়। নগর বিপ্লব ছিল সভ্যতা বিকাশের অগ্রগতির চূড়ান্ত পর্যায়।

নগর বিপ্লব কাকে বলে ও নগরায়নের পটভূমি:

যেসব কারণে নগর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

১। কৃষিতে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন নগরায়নের কারণ:

কৃষিতে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের সাথে নগরের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। কেননা নবোপলীয় কৃষক প্রতিবছরই উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করে তার নিকটস্থ শিকারী, জেলে, সংগ্রাহক, যাযাবরদের নিকট উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় করতেন এবং তার নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতেন।

এভাবে কৃষিজীবী গ্রাম গুলোর সাথে অন্যান্য পেশাজীবীদের একটি পারস্পারিক নির্ভরশীল সমাজ গড়ে ওঠে। নীল নদ, টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস সহ ও আরো বেশকিছু নদী উপত্যকায় ৫ হাজার বছর পূর্বে পশুপালন, মাছ শিকার সহ সেচের মাধ্যমে কৃষি কাজ পরিচালনার মাধ্যমেই উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভভ হয়। আর এজন্য বলা হয় ”উদ্বৃত্ত খাদ্য নেই, নগরও নেই’।

২। অধিক জনসংখ্যা নগর বিপ্লবের কারণ:

ম্যালথাসের তথ্য অনুযায়ী- জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রথমটি উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত। জনসংখ্যার ঘনবসতি নির্ধারিত হয় খাদ্য সরবরাহের ওপর। মিশরের খাল খনন ও বার্ষিক বন্যার কবল থেকে অধিবাসীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর সহ অবস্থান ও ঐক্য। ফলে নবগ্রাম গুলো বড় বড় বসতি এলাকা নিয়ে প্রথম নগরায়ন গড়ে ওঠে।

৩। কারিগর শ্রেণি নগর বিপ্লবের কারণ:

পুরোপলীয় প্রস্তর যুগে আদিম মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত।

কিন্তু যখন কারিগর শ্রেণির উদ্ভব হলো তখন তারা একই কাজে নিয়োজিত থাকার ফলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এ কারিগর শ্রেনী মূলত টিকে ছিলো- উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের উপর।

এই কারিগর শ্রেনী নগরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং এই কারিগরা নগরের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তথা নগর বিপ্লবে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪। ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্থান নগরায়নের কারণ:

ব্যবসা-বাণিজ্য দেশের ভিতরে হোক অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কারণেই হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য নগরের উদ্ভব ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

যে স্থানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে একে অপরের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে জমায়েত হয় সেখানে সাধারণত নগরের উদ্ভব হয়ে থাকে।

তাই বলা যায় ব্যবসা-বাণিজ্য নগরায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

৫। জলবায়ুর প্রভাব:

নগর গড়ে ওঠার জন্য জলবায়ুর অবদান অস্বীকার করার মতো নয় কারণ কেবলমাত্র অনুকূল জলবায়ুর প্রভাবেই, কোন বিশেষ স্থানে নগর গড়ে উঠতে পারে। জলবায়ুর অবস্থানের কারণে সেই টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল মেসোপটেমিয়ায় সর্বপ্রথম নগর জীবনের সূত্রপাত ঘটে।

তাই বলা যায় প্রতিকূল জলবায়ুর কারণে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে না পারলে সেখানে নগর গড়ে ওঠা অসম্ভব।

সুতরাং নগরায়নের জলবায়ুর ভূমিকা রয়েছে।

৬। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি নগরায়নের কারণ:

যানবাহন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি নগর বিকাশের অন্যতম কারণ। যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে সহজে দ্রব্য সামগ্রী আনা-নেওয়া করা সম্ভব হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি হয়।

ফলে নগরীর উত্থান ঘটে।

৭। ধর্মীয় তীর্থ স্থান নগর বিপ্লব এর কারণ:

ধর্মীয় তীর্থ স্থান কে কেন্দ্র করে নগর গড়ে উঠতে পারে। যেমন মক্কা-মদিনা, জেরুজালেম, ভ্যাটিকান সিটি সহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান কে কেন্দ্র করে নগর গড়ে উঠেছে।

তাই বলা যায় যে ধর্মীয় স্থান নগরায়নের একটি বড় কারণ।

৮। শাষক শ্রেণির উদ্ভব নগরায়নের কারণ:

নাগরিকদের শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাজের জন্য শাসক শ্রেণীর প্রয়োজন হয়।

ফলে অনেক নগর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণেই গড়ে উঠেছে।

৯। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনোদন:

শিক্ষা স্বাস্থ্য ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে এমন স্থানে অত্যন্ত জনপ্রিয় নগর গড়ে উঠতে পারে। মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম! আর স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোন বিকল্প নেই।

তাই স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ঘিরে ও নগরের বিস্তৃতি ঘটে। তাই বলা যায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন হতে পারে নগরায়নের একটি বড় কারন।

১০। পরিবহণ ও প্রযুক্তিগত উন্নতি নগর বিপ্লব এর কারণঃ

নীল, সিন্ধু, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস ইত্যাদি নগরে যদি পরিবহনের উদ্ভব না হতো তাহলে নগরায়ন হতো না। পাল তোলা নৌকা, চাকা যুক্ত যানবাহন, মালবাহী পশুর গাড়ি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ জিনিসপত্র আমদানি রপ্তানি করতে লাগলো। মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস এর ফলে প্রযুক্তি বিদ্যার উদ্ভব হয়।

বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চাষাবাদ করা ও বসতি স্থাপন করে যা নগর বিপ্লবের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

তাই বলা যায় পরিবহন ও প্রযুক্তির উন্নয়নের একটি অন্যতম কারণ।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে ইতিহাসের কাল বিভাজন তার অন্যতম স্তর হচ্ছে ঐতিহাসিক যুগ।

এ যুগে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা হচ্ছে নগর বিপ্লব বা নগরায়ন। এ নগর বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ কারণ বা পটোভূমি দায়ী ছিলো না।

বরং উপরে উল্লিখিত কারণ সমূহই নগরায়ন বা নগর বিপ্লবের মূল কারন। এই ছিলো নগরায়নের মোট ১০টি কারণ।

Leave a Comment