সেইন্ট অগাস্টাইন St Augustine ১ জন সেরা দার্শনিকের জীবনী ও দর্শন

সেইন্ট অগাস্টাইন এর অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করবোঃ

  • সেইন্ট অগাস্টাইন (St Augustine) এর পরিচয়।
  • কালের তত্ত ( Theory of Time).
  • মন্দের সমস্যা নিয়ে আলোচনা (The conception of Evil).
  • freedom of will.
  • বিশ্বাস ও যুক্তির সাথে ধর্মের / ঈশ্বরের অস্তিত্বর পক্ষে যুক্তি ( Relation of Religion with Faith and Reason).

সেইন্ট অগাস্টাইন (St Augustine) এর পরিচয়-

দর্শন ইতিহাসের বিখ্যাত একটি নাম সেইন্ট অগাস্টাইন। তার দর্শন মধ্যযুগের চিন্তা চেতনাকে ছাড়িয়েও রেনেঁসা যুগকেও প্রভাবিত করেছে।

এই বিখ্যাত দার্শনিক ১৩ নভেম্বর ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার থেগাস্টে জন্মগ্রহন করেন। অগাস্টাইনের বাবার নাম ছিলো পেট্রিকাস আর মায়ের নাম ছিলো সেইন্ট মনিকা।

তার পিতা বহুদেববাদে বিশ্বাসী ছিলেন ও মা ছিলেন খ্রিস্টান। সেইন্ট অগাস্টাইনের জীবনী জানা যায় তাঁর কনফেশনস গ্রন্থ থেকে।

অগাস্টাইন ছোট বেলা থেকেই মায়ের আদর্শে বড় হন এবং মায়ের চরিত্র দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু পরিণত বয়সে তার চরিত্রে বৈচিত্র আসে।

এক পর্যায়ে তিনি ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী হন। তার লিখিত বই কনফেশন এবং ঈশ্বরের নগরী ব্যাপক জনপ্রিয়।

কালের তত্ত ( Theory of Time)-

জগৎ কেনো আরো পূর্বে সৃষ্টি হয়নি? কারণ তখন পূর্ব বলে কিছুেই ছিলো না। কাল বা সময় তখনই সৃষ্টি হয়েছিলো, যখন জগৎ সৃষ্টি হয়েছিলো।

ঈশ্বর হলেন চিরন্তন বা অনন্ত। জগৎ সৃষ্টির পূর্বের ধারনাকে মাথায় রেখে বলা যায়, ঈশ্বরের নিকট অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে আসলে কিছু নেই।

ঈশ্বরের নিকট কেবলই রয়েছে বর্তমান।

ঈশ্বরের চিরন্তনতা কালের প্রবাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার নিকট সকল কাল বা সময়ই বর্তমান। ঈশ্বরের নিজের জন্য কালরে কোনো অতীত নেই।

কেননা ঈশ্বর নিজের জন্য কালের কোনো অতীত রাখেননি। সুতরাং ঈশ্বর সর্বদা কাল-প্রবাহের ঊর্ধে অবস্থান করেন।

তাহলে কাল কি? সেইন্ট অগাস্টাইনের মতে না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ। শুধু মাত্র বর্তমানেরই অস্তিত্ব রয়েছে। বর্তমান কেবলই একটি মুহূর্ত।

কেবলই কাল অতিক্রান্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে একে পরিমািপ করা যায়।

তবুও বাস্তবিক ভাবেই অতীত এবং ভবিষ্যৎ রয়েছে। এটি শুনে মনে হতে পারে যে অগাস্টইনের তত্তের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে গেলো।

এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে, অতীত এবং ভবিষ্যতকে কেবলই বর্তমান হিসেবে ভাবা যেতে পারে। যেমন অতীতকে স্মৃতি দিয়ে এবং ভবিষ্যতকে প্রত্যাশা দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

এখানে স্মৃতি এবং প্রত্যাশা উভয়ই বর্তমান ঘটনা। এটিকে তিনি বলেছেন- অতীতের একটি বর্তমান, বর্তমানের একটি বর্তমান, ভবিষ্যতের একটি বর্তমান

যেমন স্মৃতি হলো অতীতের বর্তমান, এখন যা দেখছি তা বর্তমানের বর্তমান এবং যা আশা বা প্রত্যাশা করছি তা ভবিষ্যতের বর্তমান।

তাহলে বলা যায় কাল অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত এই তিন প্রকার। কালের এই ভাগকে তিনি মেনে নেননি।

সেইন্ট অগাস্টাইন দেখলেন যে তার তত্ত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ফলে ধাঁধার এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার জন্য তাঁর মন কাদতে লাগলো।

পরে তিনি সৃষ্টিকর্তার নিকট এই বলে পার্থনা করলেন ঈশ্বর তার চেষ্টা যেনো ব্যর্থ না করে দেন। কাল সম্বন্ধে তিনি যেনো সমস্ত অজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে পারেন।

মন্দের ধারণা/সমস্যা নিয়ে আলোচনা (The conception of Evil):

খ্রিস্টান, ইহুদী ও মুসলমানরা ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বদাই ভাল বলে মনে করে থাকেন। এইরকম সত্তাকে বা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার সবচেয়ে কঠিন ধাঁধাময় প্রশ্ন হলো জগতে তাহলে কেন এত মন্দ রয়েছে তা ব্যাখ্যা করা।

বিশেষ করে কেন এত কষ্ট হচ্ছে? কেন ঈশ্বর যুদ্ধ এবং অন্যায়ের আশ্রয় দেবেন? কেন তিনি রোগ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের উপর প্রচুর বেদনা ও যন্ত্রণা দান করবেন?

ঈশ্বর যদি শুভ হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই তিনি এই কষ্টের অস্তিত্ব রাখবেন না। তিনি যদি সর্বজ্ঞানী হন তবে তিনি জানেন যে এই অশুভ বিদ্যমান।

যদি তিনি সর্বশক্তিমান হন তবে তিনি তা প্রতিরোধ করতে পারেন। তাহলে এই দুর্ভোগের কারণের মানে কি এই দাড়ায় যে ঈশ্বর বলে আসলে কিছু নেই?

কেন পৃথিবীতে মন্দ আছে? অগাস্টাইন এই প্রশ্নে বারবার ফিরে এসেছেন। অগাস্টাইন এমন এক সময়ে বাস করত যখন শক্তি ও স্থিতিশীলতার স্তম্ভ রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং তার নিজের জীবনও অশান্তি ও কষ্টে ভরা ছিল।

প্রথমে তিনি তার স্ত্রী, তার মা এবং অবশেষে তার পুত্রকে হারিয়েছিলেন। এতো কিছুর মধ্যেও সেইন্ট অগাস্টাইন ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারাননি।

সেইন্ট অগাস্টাইন উপরোক্ত প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছেন, তা পশ্চিমা চিন্তাধারাকে বদলে দেবে। প্রথমত, তিনি বলেছেন যে মন্দ রয়েছে কারণ আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে।

তার মতে, ঈশ্বর মানুষকে তাদের নিজ কর্ম ও কাজগুলি নির্বিঘ্নে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন ফলে অনিবার্যভাবে এই বেছে নেয়া কাজ থেকে ফলাফল আসে।

এমনকি রোগের মতো প্রাকৃতিক মন্দ জিনিসও অপ্রত্যক্ষভাবে মানুষের স্বাধীন কাজের সাথে সম্পর্কিত।

এই তত্ত্ব অনুসারে, একটি রোগ কেবল ছড়িয়ে পড়ে কারণ পুরুষ এবং মহিলারা নিজেরাই নিজেকে ক্ষতির পথে নিয়ে যায়।

সেইন্ট অগাস্টাইন তার জীবনের পরবর্তী সময়ে আরও ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। যেমন- আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছা বুঝতে পারি না, এবং যা আমাদের কাছে মন্দ বলে মনে হয় তা মোটেও খারাপ হতে পারে না।

অন্য কথায়, আমরা আসলে ঈশ্বরের রায় কখনোই বিচার করতে পারি না।

মন্দের দুটি সমস্যা (Two problems of evil):

(1) হয়,একজন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বিদ্যামান।
(2) আর না হলে,মন্দ বিদ্যমান।

স্পষ্টতই, (2) সত্য হলে (1) মিথ্যা হবে।

আসলে উক্ত সমস্যাটি খুব বড় সমস্যা নয়। এটি সমাধান করার জন্য, আগে দেখাতে হবে যে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সম্ভবত কোন বড় কল্যাণের জন্য কিছু মন্দকে রেখেছেন কিনা।

সেইন্ট অগাস্টাইন St Augustine
সেইন্ট অগাস্টাইন St Augustine

সেইন্ট অগাস্টাইন এর ইচ্ছার স্বাধীনতা (Freedom of will):

সেইন্টঅগাস্টিন তার ব্যাখ্যায় প্রথমেই বাইবেলের গল্প দিয়ে শুরু করেন! ঈশ্বর আদম ও হাওয়ার জন্য এমন এক নিখুঁত জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন যার মধ্যে আদম এবং হাওয়া স্বাধীন ভাবে বসবাস করছিলেন।

যেখানে আদম ও হাওয়ার ইচ্ছার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আদম এবং হাওয়া ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে বসেন এবং পাপ করেন।

তাদের পাপের জন্য ২টি শাস্তি পেতে হয়।

প্রথমত, এটি মানব জাতীর জন্য কলঙ্ক বয়ে নিয়ে এসেছিল, যাতে করে প্রতিটি পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পাপের ভগিদ্বার হয় এটি “আসল পাপ” এর মতবাদ।

দ্বিতীয়ত, আদম ও হাওয়া ঈশ্বরের আদেশের বিরুদ্ধচারণ করেছে। ফলে, আমরা আজকের প্রাকৃতিক রোগ এবং বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে এটাকে দায়ী করতে পারি।

কারন আদম ও হাওয়া পাপ করার আগে এ জাতীয় মন্দ বা অশুভর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

সুতরাং, মানবজাতির এখন যে ভোগান্তি রয়েছে তা বেঠিক নয়। আমরা আমাদের নিজের পাপের মাধ্যমে এই যন্ত্রণা নিজের উপরে এনেছি।

সত্যি বলতে ঈশ্বর আমাদের দুর্দশা রোধ করতে পারতেন। তবে কেবল তা তখনই হতো যদি আমাদের ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা না থাকতো।

কিন্তু আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকাও মন্দের চেয়ে বড় মঙ্গল।

বিশ্বাস ও যুক্তির সাথে ধর্মের / ঈশ্বরের অস্তিত্বর পক্ষে যুক্তি ( Relation of Religion with Faith and Reason) সেইন্ট অগাস্টাইন:

সেইন্ট অগাস্টানে এর যত চিন্তা ভাবনা তা ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে! ঈশ্বর নিয়ে চিন্তা করলেও তিনি সর্বদাই এক প্রকার যাতনায় ভুগতেন।

যতনার কারন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে নয়, ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়ে।

বিশ্বাস ও যুক্তি (Faith and Reason) শব্দ দুটিকে সাধারণত ধর্মীয় বিশ্বাসের ন্যাযতা প্রতিপাদনের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়! দুটো শব্দের কার্য প্রক্রিয়া প্রায় একই।

কিছু দার্শনিকদের নিকট এ দুটো বিষয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং কিভাবে তা যুক্তির মাধ্যম হিসেবে কাজ করে তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

সেইন্ট অগাস্টিন ৪র্থ শতাব্দির শেষ দিকে পুনরায় খ্রিস্টান ধর্মে ফিরে আসেন।

এরপর তিনি প্যাগানদের (Pagan) কুৎসার বিরুদ্ধে কঠোর ও যথাযথ জবাব দেন।

কেননা প্যাগানরা মনে করতো যে, খ্রিস্টানদের বিশ্বাস শুধুমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্নই ছিলো না এটি বর্বরও ছিলো।

সেইন্ট অগাস্টিন মনে করতেন বিশ্বাসের অনুসন্ধান হচ্ছে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া।

যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়াটি যুক্তি/কারন( Reason) দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং ইচ্ছার দ্বরা নির্ধারিত হয়।

তিনি বলেন, বিশ্বাস আমাদের দ্বায়বদ্ধ করে তোলে, যেমন “ঈশ্বরে বিশ্বাস” “এক ঈশ্বরে বিশ্বাস” ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতে সম্পৃক্ত করে।

সেইন্ট অগাস্টিন মনে করতেন যে প্লেটোবাদীরা (Platonist) হলেন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দার্শনিক।

কেননা তাদের আলোচনা,কোনো নিছক বস্তুর কার্যর কারণ বা জ্ঞান অর্জনের প্রণালীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা।

বরং তারা জগৎ এবং জগতের নিয়মনীতিও আলোচনা করেছেন।

ঈশ্বরের ধারনায় বিশ্বাস করার জন্য একজন মানুষের শুধুই খ্রিস্টান না হলেও চলে।

একইভাবে একজন খ্রিস্টান, কোনো দার্শনিক মতবাদের আশ্রয় গ্রহন না করেও এ ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।

পরিশেষে সেইন্ট অস্টাইন, যুক্তি ও বিশ্বাসের ঊর্ধে গিয়ে মতপোষন করেন যে- কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে পারবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না সে ঈশ্বরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসবে।

[ উক্ত কন্টেন্ট এ যে বই গুলো থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে তার পিডিএফ-Pdf ফাইল দেয়া হলো ]
* Western philosophy by B.Russel
*
Western philosophy by STACE

Leave a Comment