প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা মানব জাতির ক্রমবিকাশ ধারা সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবো! মানব জাতির ক্রমবিকাশ নিয়ে অধিকাংশ জীববিজ্ঞানী একমত হয়েছেন যে, কাছাকাছি কোন প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি।
তবে বিজ্ঞানী লিনিয়াস ১৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে মানুষের মিল খুঁজে পেয়েছেন এবং মানুষকে প্রাণীদের সাথে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন।
মনােজেনেসিস মতবাদ অনুযায়ী আধুনিক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে আদিকালের কোন লেজবিহীন বানর জাতীয় প্রাণীর মাধ্যমে।
অবশ্য নৃবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানীরা জীবাশ্ব বা ফসিলের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান! মাটির স্তরের বয়স অনুযায়ী তাদের জীবিত কাল, বয়স, জীবনপ্রণালী সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
মানব জাতির ক্রমবিকাশ ধারা সমূহ:
এপ থেকে মানব রূপান্তর:
মানুষের রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি এপ থেকে রাতারাতি সম্পন্ন হয়নি! বরং লাখ লাখ বছর ধরে খুব ধীরে ধীরে তা সাধিত হয়েছে। তবে মানুষ আর বন মানুষের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান তার সঠিক যােগসূত্র তৈরি করা খুব সহজ নয়। অবশ্য যেসব ফসিল সমগ্র পাওয়া গিয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব।
সাধারণত এদের নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক অথবা ল্যাটিন শব্দ থেকে। গ্রিক শব্দ (পিথেকাস) Pithecus যার অর্থ বনমানুষ! বৃহৎ থেকে সংকীর্ণতর ভাগে প্রাণিকুলের বংশাবলি তৈরি হয়। যেমন মানুষের শ্রেণীবর্গ প্রাইমেট, স্তন্যপায়ী, গন হােমাে, গােত্র হােমিনিড। সম্পূর্ণ মানুষ স্যাপিয়েন্স প্রজাতিভুক্ত। এভাবেই মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয় হােমাে স্যাপিয়েন্স।
মানুষের ক্রমবিকাশের গতি:
মানুষ ও বনমানুষের মধ্যবর্তী দলটিকে নৃবিজ্ঞানিগণ হােমিনিড নামে অভিহিত করেছেন! বনমানুষ সদস্য ও বনমানুষ প্রাইমেটদের প্রধান শাখার নামকরণ করা হয় পনজিডি।
মানব অভিমুখী এ শাখা থেকে একটি প্রশাখা বেরিয়ে এসেছে।তাছাড়া বনমানুষের বদলে এ শাখার প্রাণীরা হােমিনিড নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য যে, আধুনিক মানুষের এরা সরাসরি পূর্বপুরুষ নয়।
মানব জাতির ক্রমবিকাশে প্রত্নতাত্তিক অনুসন্ধান:
কৌতূহলী মানুষের অনুসন্ধানের উপকরণ ষাটের দশকের আগেও ছিল সামান্য! প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কৌতুহল ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। মানুষ নতুন উপকরণ ও পদ্ধতি অর্জন করে। হােমিনিড গােত্র পূর্ণ মানুষের দিকে এগিয়ে আসা কিংবা বনমানুষদের থেকে মানুষকে আলাদা করার কতকগুলাে উপায় বেরিয়ে আসে।
বিজ্ঞানিগণ যেসব আদিমানবের ফসিল পেয়েছেন তার মধ্যে দাঁতের পরিমাণ বেশি। তাই প্রাইমেটদের সম্বন্ধে দাঁতের বৈশিষ্ট্য মেপে বেশি ও সঠিক ধারণা নেয়া সম্ভব।
মানুষ ও বনমানুষের পার্থক্য কি ?
বনমানুষ ও মানুষ এর মধ্যে অনেক পর্থক্য রয়েছে! যেমন- মানুষের দাঁত সমান, অপরদিকে বনমানুষের সামনের দাত কৃন্তক ও ছেদক মানুষের চেয়ে লম্বা। মানুষের মাথাযর তালু ঈষৎ সমতল অপরদিকে বনানুষের মাথার তালু সমতল। প্রাণীদের পেষক দাতেরে মাথাগুলাে চর্বণের সুবিধার জন্য উঁচুনিচ থাকে।
বানরদের দাঁতের মাথার চারটি টিবি উচু হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে মানুষ ও বনমানুষের রয়েছে ৫টি। এগুলাের অবস্থান কিন্তু এক নয়! বনমানুষের মাড়িতে পুরু পেষক ও পেষকের সারি মুখের দুই পাশে সমান। মানুষের দাতের পাটি ‘V’ অক্ষরের মত। অন্যদিকে, বনমানুষের ‘u’ অক্ষরের মত।
যদিও উভয়ের সামনের দিক গােলাকার। শুধুমাত্র এসব প্রাণীর দেহাবশেষ জীবাশ্মে পরিণত হওয়ার ফলেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে।
মানুষ ও অন্য জীবের ফসিল কিভাবে সৃষ্টি হয় ?
মানুষ ও অন্য জীবের ফসিল সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। প্রথমে ধীরে ধীরে মাটির আকরিক বস্তু হাড়ে প্রবেশ করে! তবে তাদের আকার ও আকৃতি অক্ষুন্ন রেখে দ্রুত জীবাণুর ক্রিয়ায় মাংস পঁচে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু সবসময় হাড়, দাঁত ইত্যাদি সংরক্ষিত থাকে না।
যেমন, বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে বিশেষত বন ও জঙ্গলে দেহের কঠিন অংশও ক্ষয় হয়ে রাসায়নিক উপাদানে পরিণত হয়।
এভাবে একসময় দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে যদি মৃত্যর পর পরই প্রাণীদেহ আগ্নেয়গিরির ভস্ম, কাদা অথবা পাথরের আকরে ঢাকা পড়ে তাহলে অস্থি সংরক্ষণের সম্ভাবনা বাড়ে।
ক্রমবিকাশের পথে মানুষ:
মানুষের সুদীর্ঘ ক্রমবিকাশের পথে কিছু প্রাইমেটের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। ফলে এগুলাের সাথে আধুনিক কালে পরিচিত হওয়ার সূত্র তৈরি হয়েছে।
১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে মিশরের ফায়ূম মরুভূমিতে প্রাচীনতম প্রাণীর দুটি দাঁত ও চোয়াল পাওয়া গেছে! স্থানটি কায়রাে শহর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে।
বানরের তুলনায়, বনমানুষের সাথে মানুষের সাদৃশ্য বেশি বলে একে মানুষের কাছাকাছি মনে করা হয়।
এর বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয় প্রােপ্লিয়ােপিথেকাস! এদের হাড় ইউরােপ ও আফ্রিকায় পাওয়া গেছে।
প্রায় দু’কোটি বছর আগে এদের বাস ছিল। এদের মুখাকৃতি বনমানুষের মত চ্যাপ্টা ছিল। ধারণা করা হয় আজকের গীবনের মত এরা হাত দিয়ে ঝুলত ডালে এবং আধা সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো।
এর পরবর্তী ধারাটিকে মানুষের আরও কাছাকাছি মনে করা হয়! এদের একটি শাখা ১ কোটি ৪০ বছর আগে মানুষের দিকে এগিয়ে এসেছে।
এদের অন্যান্য প্রজাতি থেকে বৃদহাকারে বন মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় আমাদের সাক্ষাৎ পূর্বপুরুষ বর্তমান বনমানুষ নয়। তবে মানব শাখার পাশাপাশি বন মানুষের বিবর্তন ঘটেছে।
পনজিডিদের সূত্র:
১৯৬৬ সালে মিশরে মাথার খুলি পাওয়া যায়। ১৯৭৭ সালে বাহুর উপরের চারটি খণ্ড পাওয়া গিয়েছে! অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চেয়ে বানর সদৃশ্য এ প্রাণীটির মাথার মগজ ছিল ৬০ ঘনমিটার।
বিজ্ঞানীদের মতে ইজিপ্টোপিথেকাস বনমানুষ ও মানুষের আদিমতম যৌথ পূর্বপুরুষ।
যেসব ফসিল এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে এ সিদ্ধান্তে সমাজবিজ্ঞানীরা উপনীত হয়েছে যে বানর সদৃশ্য, শিম্পাঞ্জী, গরিলা, গীবন থেকে বিবর্তন ঘটে মানব শাখার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। যদিও অনেকের এতে মতবিরােধ রয়েছে।
ইউরােপীয় অয়েড মানব জাতির ক্রমবিকাশ ধারা:
পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের আকার আকৃতি এক রকম নয়।
মানুষের দৈহিক উচ্চতা, শ্রেণিবিন্যাস, গড়ন, চোয়ালের অবস্থা ইত্যাদি দিয়ে মানুষের শ্রেণিবিন্যাস করা চলে।
মাথার আকৃতি, চুলের বৈশিষ্ট্য এসব শ্রেণিবিন্যাসে গুরুত্ব রাখে।
তবে জাতিসমূহকে মিশ্রণ বৈচিত্রের প্রতি লক্ষ রেখে তিন ভাগে ভাগ করার মধ্যে অন্যতম হলাে ইউরােপীয় অয়েড মহাজাতি।
ইউরােপীয় অয়েড মহাজাতির আবাসস্থল সবচেয়ে বিস্তৃত ছিল। এরা বাস করত দক্ষিণ ইউরােপ ও উত্তর আফ্রিকা বেষ্টিত বিশাল ভূখণ্ডে! অতি প্রাচীন কালে এদেরই একটি শাখা এ উপকূলীয় অঞ্চলে জাপান ও কুরিল দ্বীপপুঞ্জে এরা বিস্তৃত ছিল। তবে কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর মতে অস্ট্রলয়েডদের সাথে সম্পর্ক বেশি।
আকৃতি, চুলের বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার ফলে এরা বাস করতাে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে।
কোন কোন নৃবিজ্ঞানী মনে করেন এদের সাথে নিগ্রোয়েড মহাজাতি একীভত ছিল।
হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে ধীরে ধীরে তারা বিচিত্র আবহাওয়া ও জলবায়ুর মুখােমুখি হয়! এভাবে ক্রমে ছড়িয়ে পরে ইউরােপীয় অয়েডদের স্বাভাবিক অবস্থান।
ক্রমে বিস্তৃত হয়ে এদের অবস্থান সমতল মধ্য এশিয়া উত্তর আফ্রিকায় বিস্তৃত হয়।
তবে ইউরােপীয়রা ভূমধ্যসাগরীয় নরডিক ও আলপাইন নামে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেষে বলা যায় যে একটি মহাদেশের সাথে অন্য মহাদেশের মানুষের আকৃতিগত ও বৈচিত্র এবং এমনকি তাদের ভাষাও আলাদা, শরীরের গঠন প্রণালিও আলাদা! তবে ধীরে ধীরে এসব জাতি ছড়িয়ে পড়েছে এবং এখানে তারা বসবাস শুরু করেছে।
নিগ্রোয়েড অস্ট্রালয়েড মানব জাতির ক্রমবিকাশ ধারা ও পরিচয়:
পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের আকার আকৃতি একরকম নয়। মানুষের দৈহিক উচ্চতা, ঘাড় ও চোয়ালের অবস্থা ইত্যাদি দিয়ে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়! মাথার আকৃতি, চুলের বৈশিষ্ট্য বিশেষ গুরুত্ব রাখে।
তবে জাতি সমূহকে মিশণ বৈচিত্র্যের প্রতি লক্ষ রেখে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
যারা অতীতে ইউরােপীয় অয়েড ও নিগ্রোয়েড জাতি সমূহ; মহাদেশের বিভিন্ন বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেছিলো!
অস্ট্রালয়েড মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত জাতিসমূহের অধিকাংশই উষ্ণমণ্ডলে বসবাস করে।
আফ্রিকান ও অস্ট্রালয়েডদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য ও সাদশ্য এবং সস্পষ্ট পার্থক্যও রয়েছে। নিগ্রো শিশুরা কোকড়ানাে চুল নিয়েই জন্মগ্রহণ করে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা আরাে কঞ্চিত হয়।
অন্যদিকে অস্ট্রালীয় আদিবাসী, মেলানেশীয় ও পুয়ান সহ প্রভৃতির চুলের কুঞ্চিত ভাব অনেকটা কম দেখা যায়।
আবার অস্ট্রালীয়দের গায়ের লােম নিগ্রোদের চেয়ে অনেক বেশি।
আফ্রকানদের কপাল খাড়া ও সুগঠিত কিন্তু অস্ট্রালীয়দের সেই তুলনায় অনেকটা ঢালু।
আবার আফ্রিকান মানুষদের কপালে রেখা নেই বলেই চলে।
কিন্তু অস্ট্রালীয়দের ভ্রু স্পষ্ট। আফ্রিকান নিগ্রো মানুষদের চেয়ে অস্ট্রালীয়দের নাক অনেকটা খাড়া।
তাই পরস্পর বিচ্ছিন্ন অংশে বসবাস করতে গিয়ে বসবাসকারী এ দুই ধারার জাতিগােষ্ঠীকে চুল, কপালের গড়ন, রেখা এবং নাকের গড়নের মাধ্যমে আলাদা করে শনাক্ত করা যায়।
তবে পাথর যুগের শুরুতে অস্ট্রালয়েড-নিগ্রোয়েড গােষ্ঠী মূল জাতি হিসেবে এশিয়া, ইন্দোচীন, ভারত অথবা দূর পশ্চিমে বসবাস করতাে।
পরবর্তীকালে এরা দক্ষিণ-পূর্ব বা মহাসাগরীয় এবং পশ্চিম- দ্বিমুখী ধারায় বিভক্ত হয় আরাে পরে এরা এগিয়ে যায় দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং সবশেষে পৌছে আফ্রিকায়।
এভাবে করে ভৌগােলিক অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের দেহ বৈশিষ্ট্যতেও পরিবর্তন আসতে থাকে।
মঙ্গোলয়েড মানব জাতির ক্রমবিকাশ ধারা ও পরিচয়:
মঙ্গোলয়েড জাতির আদি অবস্থান সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এশিয়ার পর্বাঞ্চলে।
গিরিপথ উপত্যকা ও নিম্নভূমি দ্বারা এ ভূখণ্ড ভৌগােলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন বলে ইউরােপিয়েড ও নিগ্রােয়েডদের সাথে এদের একটি যােগসূত্রতা ছিল।
আদি মঙ্গোলয়েডরা এশিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পর্ব অঞ্চল ছিলো।
ক্রমে এদের শাখা এশিয়ার অন্য সব অঞ্চল ও সাইবেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
সাইবেরীয় মঙ্গোলয়েডদের সাথে মিশ্রণ ঘটে।
দক্ষিণ মঙ্গোলয়েডদের মিশ্রণ ঘটতে থাকে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাতিসমূহে ইউরােপ অয়েডদের মিশ্রণ ঘটে।
এভাবে মঙ্গোলয়েড ধারা ছড়িয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, দক্ষিণ চীন, কোরিয়া ও জাপানে।