ভারতীয় বৈশেষিক দর্শনে পদার্থ রয়েছে মোট ৭টি। এই ৭ টি পদার্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে আজকের পোষ্টে।
বৈশেষিকরা দ্বৈতবাদী। তারা ঈশ্বর এবং পরমাণু উভয়েরই সহ অবস্থানের কথা স্বীকার করেন।
বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঋষি কণাদ। ন্যায় দর্শন ও বৈশেষিক দর্শনকে সমানতন্ত্র বলা হয়। উভয়ের মতেই মােক্ষই জীবের পরম পুরুষার্থ।
উভয় দর্শনই মনে করে যে অজ্ঞানতা বা মিথ্যাজ্ঞানই সকল দুঃখের মূল কারণ। বৈশেষিক দর্শনের মােক্ষ হল দুঃখের একান্ত নিবৃত্তি এবং তত্ত্বজ্ঞান বা বস্তুর যথার্থ জ্ঞানের সাহায্যেই মােক্ষ লাভ করা সম্ভব।
বৈশেষিক দর্শনে দুটি প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে—প্রত্যক্ষ এবং অনুমান। উপমানও শব্দ অনুমানেরই অন্তর্গত। জ্ঞান দু’প্রকার। যথাঃ
১। স্মৃতি (recollection)
২। অনুভব (Apprehension)।
অনুভব যথার্থ এবং অযথার্থ উভয় প্রকার হতে পারে। যথার্থ অনুভব হল প্রত্যক্ষ কিংবা অনুমিতি। অযথার্থ অনুভব হল সংশয় (doubt) এবং বিপর্যয় (illusion)।
বৈশেষিক দর্শনে পদার্থ সমূহঃ
পদের দ্বারা যে বিষয় সূচিত হয় তাই হল পদার্থ। যা প্রমিতির বিষয় তাই পদার্থ। বৈশেষিকরা ৭টি পদার্থ স্বীকার করেন।
এগুলো হলোঃ
ক্রমিক | পদার্থর নাম |
---|---|
১ | দ্রব্য, |
২ | গুণ, |
৩ | কর্ম, |
৪ | সামান্য, |
৫ | বিশেষ, |
৬ | সমবায়, |
৭ | অভাব। |
- আরো পড়ুন- মিশরের পিরামিড এর রহস্য
১। দ্রব্যঃ
বৈশেষিক দর্শনে ৭টি পদার্থের মধ্যে ১ম পদার্থ হলো দ্রব্য। দ্রব্য বলতে বর্তমানের পদার্থ বিজ্ঞানের দ্রব্যের মতো হবুহু কিছু বোঝানো হয়নি।
যে পদার্থকে গুণ এবং ক্রিয়া আশ্রয় করে বিদ্যমান করে বিদ্যমান থাকে তাকেই দ্রব্য বলা হয়। দ্রব্য গুণ ও কর্ম থেকে পৃথক এক স্বতন্ত্র বস্তু।
দ্ৰব্য আবার ৯ প্রকার। যথাঃ
- ক্ষিতি,
- জল,
- তেজ,
- বায়ু,
- আকাশ,
- কাল,
- দিক,
- আত্মা এবং
- মন।
এই নয়টি দ্রব্যের মধ্যে প্রথম পাঁচটিকে বলা হয় ভূত। এদের প্রত্যেকেরই একটি বিশেষ গুণ আছে। গন্ধ হল ক্ষিতির, রস হল জলের, রূপ হল তেজের, স্পর্শ হল বায়ুর এবং শব্দ হল আকাশের বিশেষ গুণ।
৯ টি দ্রব্য বিস্তারিতঃ
ক্ষিতি, জল, তেজ ও বায়ুর পরমাণু সমূহ নিত্য। এই সব পরমাণুর সংযােগে যে সব যৌগিক বস্তু উৎপন্ন হয়, সেগুলি অনিত্য।
এই জগতের যাবতীর উৎপত্তিশীল দ্রব্যের মৌলিক উপাদান হল পরমাণু।
- আরো পড়ুন- পৃথীবির উৎপত্তি হলো কিভাবে
বৈশেষিকদের মতে যে কোন অবয়ববিশিষ্ট বা অংশযুক্ত বস্তুকে যদি ক্রমাগত বিভাগ করা যায় তাহলে আমরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর, তারপর আরও ক্ষুদ্র এই ভাবে এমন এক অবিভাজ্য সূক্ষ্ম অংশে এসে উপনীত হয় যে তারপর তাকে আর ভাগ করা চলে না।
এই ক্ষুদ্রতম সূক্ষ্ম জড় কণিকাগুলিই হল পরমাণু।
এই পরমাণুগুলি হল সৎ, নিত্য, অনুমেয়, অবিভাজ্য এবং অকারণ। এই পরমাণুগুলি এত ক্ষুদ্র যে এগুলিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অনুমানের সাহায্যেই আমরা এগুলির অস্তিত্ব জ্ঞাত হই।
পরমাণুগুলি নিত্য, যেহেতু এদের কোন উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। পরমাণু সংখ্যায় বহু এবং ভিন্ন।
প্রত্যেকটি পরমাণুর মধ্যে এমন এক বিশেষ পদার্থ আছে যার জন্য কোন একটি পরমাণু অন্য পরমাণু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আকাশ হল নিত্য, সর্বব্যাপী এবং অতীন্দ্রিয়। শব্দগুণ যাকে আশ্রয় করে থাকে তাই হল আকাশ। দিক হল এক, অখণ্ড এবং সর্বব্যাপী।
দূর’, ‘নিকট’, ‘পুর্ব’, ‘পশ্চিম প্রভৃতির ধারণা বা অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দিকের অস্তিত্ব অনুমান করি। দিকের মত কালও এক, অনন্ত এবং সর্বব্যাপী।
অনিত্য পদার্থের উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিনাশের কারণ হল কাল । আত্মা হল এক শাশ্বত এবং সর্বব্যাপী দ্রব্য। আত্মা হল জ্ঞান বা চেতনার আশ্রয়। আত্মা দু’প্রকার-জীবাত্মা এবং পরমাত্মা।
জীবাত্মা অসংখ্য, পরমাত্মা এক। পরমাত্মাই ঈশ্বর। আত্মা বিভু হলেও শরীরভেদে ভিন্ন ভিন্ন। আত্মা স্বরূপতঃ নিগুণ ও নিষ্ক্রিয়, সে কারণে চৈতন্য আত্মার স্বাভাবিক গুণ নয়, আগন্তুক গুণ। মনও আত্মার মত একটি নিত্য দ্রব্য।
মন হল অন্তরীন্দ্রিয় যার সাহায্যে আত্মা সুখ, দুঃখ, দ্বেষ প্রভৃতি গুণগুলিকে প্রত্যক্ষ করে। মন পরমাণু বিশেষ।
আর সেই কারণে মন অতি ক্ষুদ্র এবং সূক্ষ্ম পদার্থ। মন নিত্য। এর উৎপত্তিও নেই, আর বিনাশও নেই।
২। গুণঃ
বৈশেষিক দর্শনে গুণ হলো ২য় গুরুত্বপূ্ণ পদার্থ। গুণ একটি বিশেষ ও সতন্ত্র পদার্থ যা দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে।
গুণ সব সময় দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। দ্রব্যের স্বতন্ত্র সত্তা আছে, কিন্তু গুণের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। দ্রব্যে গুণ থাকে কিন্তু গুণের কোন গুণ নেই।
গুণ দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকলেও গুণ একটি স্বতন্ত্র পদার্থ। গুণ গতিহীন এবং নিক্ৰিয়। গুণ চব্বিশ প্রকার। এগুলো হলোঃ
- রূপ,
- রস,
- গন্ধ,
- স্পর্শ,
- সংখ্যা,
- পরিমাণ,
- পৃথকত্ব,
- সংযােগ,
- বিভাগ,
- পরত্ব,
- অপরত্ব,
- বুদ্ধি,
- সুখ,
- দুঃখ,
- ইচ্ছ,
- দ্বেষ,
- প্রযত্ন,
- গুরুত্ব,
- দ্রবত্ব,
- স্নেহ,
- সংস্কার,
- ধর্ম,
- অধর্ম
- এবং শব্দ।
৩। কর্মঃ
কর্ম হল জড় পদার্থের গতি। গুণ যেমন কোন দ্রব্যকে আশ্রয় করে বিরাজ করে, কমও অনুরূপভাবে কোন দ্রব্যকে আশ্রয় করে বিরাজ করে।
কর্ম ৫ প্রকার। যথাঃ
- উৎক্ষেপণ,
- অধক্ষেপণ,
- আকুঞ্চন,
- প্রসারণ ও
- গমন।
৪। সামান্যঃ
একই শ্রেণীর বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য শ্রেণীভুক্ত প্রত্যেকটি ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে সমানভাবে বর্তমান থাকে। একে সামান্য বলে।
মনুষত্ব নামক – এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য সকল মানুষের মধ্যেই বর্তমান যার জন্য সব মানুষই মনুষ্য পদবাচ্য।
সামান্য হল নিত্য পদার্থ। দ্রব্যের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু সামান্য হল নিত্য, এর কোন বিনাশ নেই।
যদিও সামান্য বহু ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যেই বিদ্যমান তবু সামান্যের ব্যক্তি বা বস্তু নিরপেক্ষ সত্তা আছে। সামান্যের আর এক নাম জাতি।
৫। বিশেষ্যঃ
বিশেষ হলো সামান্যের সম্পূর্ণ বিপরীত এক পদার্থ। অংশহীন নিত্য দ্রব্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হল বিশেষ। অনিত্য পদার্থের বিশেষ নেই।
নিত্য পদার্থেই বিশেষের অধিষ্ঠান। প্রতিটি পরমাণুর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যে কারণে একটি পরমাণু আর একটি পরমাণু থেকে পৃথক। বিশেষ কথাটি থেকেই বৈশেষিক নামের উৎপত্তি।
৬। সমবায়ঃ
দুটি পদার্থ যখন এমন এক অবিচ্ছেদ্য ও নিত্য সম্বন্ধে যুক্ত হয় যে, পদার্থ দুটির মধ্যে একটি আর একটিতে থাকে, তখন ঐ সম্বন্ধকে সমবায় সম্বন্ধ বলে।
সংযােগ সম্বন্ধ হল অনিত্য ও বাহ্য সম্বন্ধ। কিন্তু সমবায় হল নিত্য বা স্থায়ী সম্বন্ধ।
যেমন অবয়বের সঙ্গে অবয়বীর, দ্রব্যের সঙ্গে গুণের, সূত্রের সঙ্গে বস্ত্রের, সমগ্রের সঙ্গে অংশের এবং জাতির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ।
৭। অভাবঃ
অভাব হল নঞর্থক পদার্থ (Negative Category)। অভাব মানে যার অস্তিত্ব নেই। যখন বলি বিশুদ্ধ জলে গন্ধ নেই, টেবিলের উপর কলমটি নেই, তখন বস্তুতঃই কতকগুলি বস্তুতে অন্য বস্তুর অভাবের কথা বলছি।
অভাব দুপ্রকারের—সংসৰ্গাভাব এবং অন্যান্যাভাব। সংসৰ্গাভাব বলতে কোন কিছুতে অন্য কোন কিছুর অভাব বােঝায়। অন্যান্যাভাব বলতে বােঝায় যে একটি বস্তু আর একটি বস্তু নয়।
সংসৰ্গাভাব তিন প্রকার-প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব এবং অত্যান্তাভাব। উৎপন্ন হবার পুর্বে বস্তুর যে অভাব থাকে এবং উৎপন্ন হলে যা থাকে না, তাকে প্রাগ ভাব বলে। যেমন, মাটিতে মুর্তির অভাব।
কোন বস্তু উৎপন্ন হবার পর ধ্বংস হলে বস্তুটির যে অভাব তাকে ধ্বংসাভাব বলে। ঘট ভেঙে গেলে ঘটের ধ্বংসাভাব হল, কারণ ঘটের ভাঙা টুকরােগুলিতে আর ঘটের অস্তিত্ব নেই।
অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ—এই তিন কালেই অর্থাৎ সকল সময়েই দুটি বস্তুর মধ্যে সম্বন্ধের অভাবই অত্যান্তাভাব। যেমন, বায়ুতে রূপের অভাব, ঘটে চেতনার অভাব।
দুটি বস্তুর পারস্পরিক ভেদ হল অন্যান্যাভাব, যেমন ঘট কাপড় নয়। ঘট কাপড় থেকে পৃথক, সুতরাং ঘটে কাপড়ের অভাব, আর কাপড়ে ঘটের অভাব।
বৈশেষিক দর্শনে মন্তব্যঃ
বৈশেষিকরা পরমাণুবাদের সাহায্যেই এই জড় জগতের সৃষ্টি এবং লয় ব্যাখ্যা করেছেন। পরমাণুর সংযােগ এবং বিযুক্তিতে যৌগিক বস্তুর উৎপত্তি এবং বিনাশ।
পরমাণুগুলি আপনা আপনি সংযুক্ত বা বিযুক্ত হতে পারে না।
সুতরাং কোন বুদ্ধিমান কর্তা পরমাণুগুলিকে সংযুক্ত এবং বিযুক্ত করেন। এই বুদ্ধিমান কর্তা হলেন ঈশ্বর। নিত্য পদার্থের কোন উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। ঈশ্বর জগতের নিমিত্ত কারণ, পরমাণু জগতের উপাদান কারণ।
প্রশ্ন উত্তরঃ
এর প্রতিষ্ঠাতা হলে ঋষি কণাদ।
মোট ৭ টি পদার্থ রয়েছে।
দ্রব্য মোট ৯ প্রকার। যথা: ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা এবং মন।
যার ওজন আছে, স্থান দখল করে এবং বল প্রয়োগে বাধার সৃষ্টি করে তাকে পদার্থ বলে।
হ্যা।
সোর্স – গুগল ও ইন্টারনেট