ডাব, কলা ও পেঁপে- এই ৩ টি ফল আমাদের দেশে সারা বছর পাওয়া যায় বলে, এগুলোকে বারমাসি ফল বলা হয়! আজ আমরা শুধু কাঁচা ও পাকা পেঁপে খাওয়ার কয়েকটি বিশেষ বিশেষ উপকারিতা কি তা জেনে নিব।
পেঁপে পরিচিতি:
পেঁপে আমাদের দেশে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত একটি ফল। সারা বছর এ ফল বাজারে সবজি অথবা পাকা ফল হিসেবে, ফলের দোকানে পাওয়া যায়।
পেঁপের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যারিকা পাপায়া (Carica Papaya) এবং পেঁপের ইংরেজি Papaya. পেঁপের এই ইংরেজি নাম “পাপায়া” অনেক শ্রুতিমধুর।
এর উৎপাদন এলাকা গ্রীষ্মমণ্ডল হতে নাতিশীতােষ্ণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। পেঁপে গাছ দ্রুত বর্ধণশীল ও স্বল্প আয়ুবিশিষ্ট গাছ।
গাছ লাগানাের ৯-১৪ মাসের মধ্যে ফল ধরে। পেঁপের গায়ে ৮০% রঙ ধরলে পেঁপে তােলার উপযুক্ত হয়।
পেঁপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরাসরি ফল হিসেবে খাওয়া হয়। কাঁচা পেঁপে সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাকা পেঁপে থেকে জুস, জ্যাম এবং স্কোয়াশ এবং কাঁচা পেঁপে থেকে আচার ও চাটনি পাওয়া যায়।
কাঁচা পেঁপেতে প্রােটিওলাইক এনজাইম যেমন- প্যাপাইন ও কাইমাে প্যাপাইন থাকে। এর কারণে রান্নার সময় মাংস নরম করতে কাঁচা পেঁপে ব্যবহার করা হয়।
পেঁপের পুষ্টিমান:
তুলনামূলকভাবে পাকা পেঁপে, কাঁচা পেঁপের চেয়ে পুষ্টিমানের দিক থেকে উন্নত। পাকা পেঁপেতে শর্করা, খাদ্য শক্তি, ক্যালসিয়াম, ক্যারােটিন ও ভিটামিন-সি বেশি আছে।
কিন্তু কাঁচা পেঁপের মধ্যে পেপিন নামক একটি জারক রস আছে যা আমিষকে হজম করতে সাহায্য করে।
কাঁচা পেঁপেতে বেশি লৌহ আছে। আমাদের দেহে যে ভিটামিন-সি ও ক্যারােটিন প্রয়ােজন তা আমরা ৫০ গ্রাম পাকা পেঁপে থেকেই পেয়ে থাকি।
পেঁপের পুষ্টিমানের তালিকা:
১০০ গ্রাম কাঁচা পেঁপের পুষ্টিমান:
পুষ্টি উপাদান: | পরিমান: |
আমিষ | ০.৯ গ্রাম |
শ্বেতসার | ৬.৪ গ্রাম |
চর্বি | ০.৮ গ্রাম |
খনিজ লবণ | ১.৩ গ্রাম |
ভিটামিমন বি১ | ০.৪০ মি.গ্রাম |
ভিটামিন বি২ | ০.০২ মি.গ্রাম |
ভিটামিন সি | ৬ মি.গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ১৩ মি. গ্রাম |
লৌহ | ০.৯ মি. গ্রাম |
ক্যারোটিন | ৫৬০ মাই. ক্যালরি |
খাদ্য শক্তি | ৩৬ কি. ক্যালরি |
জলীয় অংশ | ১০.৭ গ্রাম |
১০০ গ্রাম পাকা পেঁপের পুষ্টিমান:
পুষ্টি উপাদান: | পরিমান: |
আমিষ | ১.৯ গ্রাম |
শ্বেতসার | ৮.৩ গ্রাম |
চর্বি | ০.২ গ্রাম |
খনিজ লবণ | ০.৭ গ্রাম |
ভিটামিমন বি১ | ০.০৮ মি. গ্রাম |
ভিটামিন বি২ | ০.০৩ মি. গ্রাম |
ভিটামিন সি | ৫৭ মিলি গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ৩১ মিলি গ্রাম |
লৌহ | ০.৫ মিলি গ্রাম |
ক্যারোটিন | ৮১ মাই ক্যালরি |
খাদ্য শক্তি | ৪২ কি. ক্যালরি |
জলীয় অংশ | ৮৮.৪ গ্রাম |
পেঁপে থেকে তৈরি হয় এমন খাবার কি কি:
কাঁচা ও পাকা পেঁপে থেকে অনেক ধরনের খাদ্য তৈরি করা যায়! তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি খাবার হচ্ছে:
১) পেঁপে থেকে তৈরি হালুয়া
২) পেঁপের তৈরি চাটনি
৩) পেঁপে দিয়ে সালাদ
৪) পেঁপে থেকে স্যুপ
৫) পেঁপের জ্যাম
৬) পেঁপের ক্যান্ডি
৭) পেঁপে থেকে পায়েস
৮) পেঁপের তৈরি আচার
৯) পেঁপের ঝোল তরকারি
১০) পেঁপে দিয়ে ভাজি
১১) পেঁপের ভর্তা
১২) পেঁপে দিয়ে খিচুড়ি
কাঁচা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা সমূহ:
১) কাঁচা পেপে বুকের দুধ বাড়ায়:
নিয়মিত কাঁচা পেঁপের তরকারি খেলে সদ্য বাচ্চা সন্তান জন্ম দেয়া নারীদের স্তনের দুধ বাড়ে যায়।
২) কাঁচা পেঁপে হজম শক্তি বাড়ায়:
হজম সম্পর্কিত যে কোনাে অসুখে কাঁচা পেঁপে বা পেঁপের আঠা খেলে তা অতি দ্রুত নিরাময় হয়।
৩) কাঁচা পেঁপে খেলে পেট পরিষ্কার হয়:
প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এবং রাতে ভাত বা রুটি খাওয়ার পর এক টুকরা কাঁচা পেঁপে ভালাে করে চিবিয়ে এক গ্লাস পানি পান করলে সকালে পেট পরিষ্কার হয়।
৪) পেঁপের আঠা কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো করে:
কাঁচা পেঁপে বা পেঁপে গাছের আঠা পেটের অসুখ সহ, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতি রােগের জন্যও বিশেষ উপকারী।
৫) কাঁচা পেপে ডায়রিয়ায় উপকারি:
পেঁপের তরকারি নিয়মিত খেলে উদরাময়ে উপকার হয়।
৬) কাঁচা পেঁপে আমাশয়ে উপকার করে:
আমাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার অদ্ভুত শক্তি আছে কাঁচা পেঁপের আঠায়।
পাকা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা সমহ:
৭) পাকা পেঁপে হৃদস্বাস্থ্য ভালো রাখে:
প্রচুর পরিমাণ আঁশ, ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে পেঁপেতে। এই উপাদানগুলাে রক্তনালিতে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল জমতে বাধা দেয়।
তাই হৃদস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং উচ্চ রক্তচাপ এড়াতে পেঁপে খেতে পারেন নিয়ম করে।
৮) পাকা পেঁপে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে:
আমাদের মধ্যে অনেকেই শরীরের মেদ ঝরাতে চান! তাঁদের খাদ্য তালিকায় পেঁপে রাখতে হবে। একদিকে যেমন কম ক্যালরি আছে, অন্য দিকে থাকা আঁশ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে।
তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে সবজি হিসেবে পেঁপে বিশেষ উপকারি ফল।
৯) পাকা পেঁপে রোগ প্রতিরোধ করে:
দেহের রােগ প্রতিরােধ ব্যবস্থা জোরদারে ভূমিকা রাখে পেঁপে। নিয়মিত পেঁপে খেলে সাধারণ রােগবালাই দূরে থাকে।
১০) ডায়াবেটিস রােগের উপকার করে:
ডায়াবেটিস রােগীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ফল হলো এই পেঁপে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে পেঁপে শুধু ডায়াবেটিস রােগীদের জন্যই প্রয়ােজনীয় ফল নয় বরং, ডায়াবেটিস রােগ এড়ানাের জন্যও পেঁপে খেতে হবে।
১১) পাকা পেঁপে চোখ ভালো রাখে:
পাকা পেঁপেতে থাকা ভিটামিন এ চোখ ভালাে রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া বয়সজনিত ক্ষীণদৃষ্টি রােগ প্রতিরােধেও পেঁপের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য।
১২) পাকা পেঁপে বয়স ধরে রাখে:
পেঁপের মধ্যে থাকা উপাদানগুলাে বয়সের ছাপ লুকিয়ে ফেলতে খুব দক্ষ। নিয়মিত পেঁপে খেলে ত্বকে বলিরেখা পড়ার প্রবণতা ধীর হয়ে যায়।
১৩) পাকা পেপে ক্যানসার প্রতিরােধী:
কোলন ও প্রােস্টেট ক্যানসার প্রতিরােধে পাকা পেঁপে উপকারী।
১৪) পাকা পেঁপে হজমশক্তি বাড়ায়:
উৎসব-পার্বণে ভূরিভােজটা একটু বেশিই হয়ে যায়। তখন বিড়ম্বনাও কম হয় না। হজমশক্তি বাড়াতে এবং পেটের গােলযােগ এড়াতেও খেতে পারেন এই পেঁপে।
১৫) পাকা পেঁপে জলের অভাব পূরণ করে:
প্রতি ১০০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী পাকা পেঁপেতে ৮৮.৩ গ্রাম জলীয় পদার্থ রয়েছে। তাই; দেহে জলের অভাব থাকলে আমরা পাকা পেঁপে খাওয়ার মাধ্যমে বিশেষ উপকারিতা পেতে পারি!
কাঁচা পেঁপে ও পাকা পেঁপের আরো স্বাস্থ্য উপকারিতা:
প্রিয় পাঠক, কাঁচা ও পাকা সকল পেঁপে আমাদের জন্য যে কত উপকারি, তা নিশ্চয় আমরা এতোক্ষণে বুঝে গেছি! বাজারে সবজি হিসেবে সারা বছর, সারা দেশে কাঁচা পেঁপে পাওয়া যায়।
বাজারে যত ধরনের সবজি বা কাঁচা তরকারি কিনতে পাওয়া যায়, পেঁপের দাম সবার চেয়ে কম থাকে। এতে করে আমরা কম দামে সেরা সবজি কেনার সুযোগ পাই।
কাঁচা পেঁপের মতো পাকা পেঁপে ফল হিসেবে সারা বছর ফলের দোকানে পাওয়া যায়। অন্য ফলের তুলনায় পাকা পেঁপের দাম অনেক কম থাকে।
বাজারে সারা বছর পেঁপের চাহিদা থাকায় পেঁপে চাষিরা নিশ্চিন্তে সারা বছর পেঁপে চাষ করে থাকেন।
অন্য ফসলের তুলনায় পেঁপে চাষ করা একটু বেশি লাভজনক। কারণ একবার গাছে পেঁপে ধরা শুরু করলে অনেক দিন যাবৎ ফল পাওয়া যায়।
তাছাড়া, বসত বাড়ির আনাচে, কানাচে সহজেই পেঁপে গাছ বেড়ে ওঠে! একটি পেঁপে কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ বছর ফল পাওয়া সম্ভব।
আমাদের মধ্যে অনেকেই শখের বসে টবে, ছাদে বা বাগানের এক পাশে পেঁপে গাছ রোপন করে থাকি।
পেঁপে গাছের সুন্দর ও সাজানো গোছানো শাখা বিন্যাস বাগানের সৌন্দর্য্য বর্ধন করে। পেঁপের ডাল-পালা কম হয় বলে, জায়গাও কম লাগে।