সক্রেটিসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা এবং উদাহরণ সহ প্রয়োগ আলোচনা

সত্য অনুসন্ধানে সক্রেটিসের পদ্ধতি খুবই কর্যকর। আজকের আমরা সক্রেটিসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করবো! মানুষের জ্ঞানানুশীলন ও সত্য অনুসন্ধানের ইতিহাসে সক্রেটিস এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।

দার্শনিক চিন্তুার ক্ষেত্রে সক্রেটিস যে অবদান রেখে গেছেন, তার ফলে, তিনি আজো সারা বিশ্বে দর্শন জগতের অন্যতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে প্রতিয়মান।

মহামতি সক্রেটিস এমন এক দার্শনিক গোষ্ঠীর জনক, যাদের মতবাদ ও আদর্শ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ২ হাজার বছর ধরে প্রভাবিত করে আসছে।

তেমনি দর্শন চর্চা, জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানে সক্রেটিসের পদ্ধতি অন্যতম অলোচিত বিষয়।

সক্রেটিসের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

সক্রেটিসের জন্ম হয় ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তৎকালীন গ্রিসের এথেন্স নগরীতে এলোপাকি গোত্রে এবং সক্রেটিসের বাবার নাম ছিলো সফ্রোনিস্কাস এবং মায়ের নাম ছিলো ফিনারিটি যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ছিলো জানথিপি। জানথিপির বয়স সক্রেটিসের থেকে অনেক কম ছিলো।

সংসার জীবনে তাঁদের তিন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। যাঁদের নাম ছিল লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজেনাস! সক্রেটিস তাঁর শাস্তি কার্যকর হওয়ার পূর্বে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দেন।

এরপর নিজ পুত্রদের ত্যাগ করার জন্য সক্রেটিসের বন্ধু ক্রিটো তার সমালোচনা করেছিলেন।

সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদর্শন ছিলেননা। তাঁর টাকবিশিষ্ট মাথা, চ্যাপ্টা অবনত নাক, ছোটো ছোটো চোখ, স্ফীত উদর এবং অস্বাভাবিক গতিভঙ্গির সমন্বয়ে গঠিত ছিল সামগ্রিক চেহারা।

দেহের শ্রী তেমন না-থাকলেও তার রসবোধ ছিল প্রখর। যেমন রঙ্গ করে প্রায়শই বলতেন: “নাসারন্ধ্রটি বড়ো হওয়ায় ঘ্রাণ নেওয়ার বিশেষ সুবিধা হয়েছে নাকটি বেশি চ্যাপ্টা হওয়াতে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায়না।”

অধিকাংশের বর্ণনামতেই তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান করতেননা। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারই ছিল তার শিক্ষায়তন! দর্শন অনুশীলন করতে গিয়ে সংসার ও জীবিকা সম্পর্কে খুবই উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

এ কারণে শেষ জীবনে তাঁর পুরো পরিবারকেই দারিদ্র্য ও অনাহারের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়! বেশির ভাগ সময়েই তিনি তাঁর শিষ্যদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতেন।

সক্রেটিসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা:

সক্রেটিসের দার্শনিক পদ্ধতি ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত। তার পদ্ধতিগুলো নিম্নলিখিত আকারে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ
(১) তর্ক শাস্ত্রানুযায়ী খন্ডন পদ্ধতি (Elenchus Method)
(২) ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতি তন্ত্র (Maieutic Method)
(৩) দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectical Method)

তর্ক শাস্ত্রানুযায়ী খন্ডন পদ্ধতি (Elenchus Method):

সক্রেটিসের এই পদ্ধতিতে প্রথমেই প্রশ্ন করতেন। এর মাধ্যমে তিনি কোনো বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করতেন! প্রশ্নের এবং তর্কের মাধ্যমে উত্তর দাতার কাছ থেকে তিনি কোনো বিষয়ের সত্য সম্পর্কে অনুসন্ধান করতেন। এভাবে উত্তর দাতা নিজেই নিজের প্রশ্নে উত্তর উপলব্ধি করতে পারতো।

ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতি তন্ত্র (Maieutic Method):

সক্রেটিসের জ্ঞানের এই পদ্ধতি, তার নিজ মাতার ধাত্রী বিদ্যার সাথে তুলনা করা যায়! নিজেকে পরমার্থিক জ্ঞানে ধাত্রী বলে অবিহিত করেন। কেননা ধাত্রী হিসেবে সক্রেটিসের মা যেমন করে প্রসব কালে সন্তান ভূমিষ্ট হতে প্রসূতিকে সাহায্য করতেন, ঠিক তেমন করে; সক্রেটিসও তাঁর ইতিবাচক এই পদ্ধতিতে সত্য ও জ্ঞানের বহিপ্রকাশে সাহায্য করতেন।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectical Method):

এই দ্বান্দিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো প্রথমে অন্যর মতকে সাদরে গ্রহণ করা। ফলে, সক্রেটিস তাঁর পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষের মত স্বীকার করতেন। কিন্তু পরে, যৌক্তিক উপায়ে স্বীকার করা মতকে খন্ডন করে, সত্যকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন।

যেমন সক্রেটিস প্রশ্ন-উত্তরের আকারে আলোচনা শুরু করতেন। এরপরে বিরুদ্ধ পক্ষের জন্য তর্কের ফাঁদ পাততেন। তার প্রতিপক্ষ যতক্ষণ না পরাজিত হয়ে নিজের ভূল, নিজে নিজে স্বীকার করতেন ততক্ষণ প্রশ্নের পর প্রশ্নের তীর ছুড়তেন। সক্রেটিসের এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি আবার সক্রেটিসের শ্লেষ বা Socratic irony নামেও অধিক পরিচিত।

সক্রেটিসের এই দ্বান্দিক পদ্ধতির একটি অন্যতম ইতিবাচক দিক রয়েছে। অনপেক্ষ সত্য অস্ত্বিত্বশীল, সার্বিক সংজ্ঞাই যথার্থ জ্ঞানের উপায় এই বিশ্বাসের উপরেই সক্রেটিস তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন।

সক্রেটিক পদ্ধতির অপরিহার্য উপাদানঃ

(১) সক্রেটিক পদ্ধতি আমাদেরকে মূল্যবোধ, নীতি এবং বিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন ব্যবহার করে।

(২) সক্রেটিসের পদ্ধতি নৈতিক শিক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যেমন- কিভাবে একজনকে বাঁচতে হবে তার উপর।

(৩) সক্রেটিসের পদ্ধতি এমন একটি পরিবেশ চায়, যাকে ঠিক “উৎপাদনশীল অস্বস্তি (productive discomfort)” হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

সক্রেটিসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা সহ উদাহরণ প্রয়োগ:

সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তার মূল লক্ষ্য ছিলো জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান বিতান আর সমাজকে মূর্খতার খোলস থেকে বের করে আনা! সক্রেটিস তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিরে মাধ্যমে প্রায়ই উপস্থিত জনতার মাঝে প্রশ্ন ছুরে দিতেন।

একবার সক্রেটিস তার বন্ধুকে প্রশ্ন করে বসলেন যে- ন্যায় কি? 

উত্তরে তার বন্ধু জবাব দিলেন- যার যা প্রাপ্য তা তাকে দিয়ে দেয়াই হলো ন্যায়।

এবার সক্রেটিস কোনো তর্ক না করে, একমত পোষণ করলেন। পরে আবার বললেন- ধরো একজন আমার কাছে তার তরবারি আমানত রেখেছে। সে যখন তা ফেরত চাইবে, তখন তা ফেরত দেয়াই কি ন্যায় কাজ হবে?

উত্তরে সক্রেটিসের বন্ধু বললো- অবশ্যই। তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেয়াই ন্যায় সংঙ্গত কাজ হবে।

এটা শুনে সক্রেটিস- মৃদু হাসলেন।

এরপর বললেন, তরবারি আমানত রাখা লোকটি তার নিজ ভাইয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধিয়েছে এবং ভাইকে শায়েস্তা করার জন্য তরবারি নিতে চায়।

তাই আমি যদি তার তরবারি তাকে ফিরিয়ে দেই- তার ভাইকে সে হত্যা করতে পারে।

তাহলে এই পরিস্থিতিতে তরবারি ফিরিয়ে দেয়া কি ন্যায় হবে ?

এবার, জবাবে সক্রেটিসের বন্ধু বললেন- না।

সুতরাং পরিস্থিতি অনুধাবণ করে, নিজ প্রজ্ঞার দারস্থ হয়ে আমাদের সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে হবে।

তাই বলতে পারি, উপরের উদাহরণের অনুরুপ করে, সক্রেটিসের পদ্ধতিকে আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে প্রকৃত সত্য ও জ্ঞানের পথ পেতে পরি।

সত্যর কাছে পরাজিত না হয়ে হাসি মুখে জীবন উৎসর্গ শুধু সক্রেটিসরাই করতে পারেন।

আজ সমাজের পরতে পরতে মিথ্যা আর অলিকতার রাজত্ব।

তাই সত্য অনুসন্ধান আর শুভ, সুন্দর এবং মঙ্গলের পথে হোক আমাদের আগামীর যাত্রা।

Leave a Comment