পাল বংশের ৪০০ বছরের শাসন আমল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। বলা হয় বাংলায় পাল যুগের শাসন সবচেয়ে গৌরবময় শাসন আমল।
এই পাল যুগেই শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য সহ সব কিছুতেই বাংলার গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পাল বংশ টোটাল চার শত বছর বাংলা শাসন করে।
বাংলা, বিহার এবং উত্তর ভারতের আরো বেশ কিছু অঞ্চল মিলিয়ে পাল বংশের বিস্তার ছিলো। আমরা জানার চেষ্টা করবো এই চারশো বছরের ইতিহাসে বাংলায় পালদের কি কি অবদান এবং সফলতা ছিলো।
পাল বংশের রাজনৈতিক ইতিহাস আমরা আলোচনা করবো না। অর্থাৎ পাল আমলে কে কার পরে শাসন ক্ষমতায় এসেছে, তা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো না।
এই পাল শাসন আমলে বাংলার সমাজ সংস্কৃতি, জীবন-দর্শন কেমন ছিলো, আমরা তা জানার চেষ্টা করবো।
পাল যুগের যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো তা হলোঃ
১। বাংলায় পাল যুগের শাসন পূর্ব ইতিহাস
২। মাৎস্যন্যায় অবস্থা ও গোপালের আবির্ভাব
৩। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পরিচয়
৪। পাল বংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
৫। পাল বংশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
৬। পাল শাসন ব্যবস্থার ধরণ ও অবদান
৭। বাংলায় পাল শাসন আমলে সাহিত্যে অবদান
৮। শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় পালদের অবদান
৯। স্থাপত্য ক্ষেত্রে বাংলায় পাল যুগের সাফল্য
১০। ভাস্কর্য ও চিত্র শিল্পে পালদের অবদান
১১। বাংলায় পাল যুগের শাসন আমলের অর্থনীতি
১। বাংলায় পাল যুগের শাসন পূর্ব ইতিহাসঃ
শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় রাজ বংশের রাজা। ৬৩৭ সালে শশাঙ্কেকর মৃত্যুর পরে, তার রাজ্য পরিচালনার মতো যোগ্য কোনো শাসক ছিলো না! ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় কোনো যোগ্য শাসকের আগমন ঘটেনি।
ফলে রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে এই ১০০ বছর বাংলায় অরাজক অবস্থা বিরাজ করে।
আঞ্জমঞ্জশ্রী নামক গল্পগ্রন্থ থেকে বাংলার এই সময়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই বর্ণনায় বাংলার এই অরাজক অবস্থাকে মাৎস্যন্যায় বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
মাৎস্যন্যায় বলতে দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বোঝানো হয়েছে। ঐ সময়ের উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মন সম্প্রদায় কর্তৃক নিম্ন বর্ণের সম্প্রদায়ের উপর জুলুম ও নির্যতন চলতো বলে বর্ননা পাওয়া যায়।
অপর দিকে এই অরাজকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো যে, বাংলার বাহিরের লোকজন ব্যাঙ্গ বা উপহাস করে বাংলাকে গৌড়তন্ত্র বলে ডাকতো।
ঠিক এই অরাজকতা পূর্ণ অবস্থায় বাংলার বাহিরের শাসকরা সুযোগ বুঝে বাংলার বিভিন্ন অংশ বা অঞ্চল দখল করে নিতে থাকে।
যেমন কনৌজের রাজা যশ বর্মন বঙ্গের দক্ষিন অঞ্চল সহ অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়। এছাড়া কাশ্মিরের রাজা ললিতাদীপ্ত বাংলার পশ্চিমের কিছু অংশ দখল করেন।
হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরে শশাঙ্কের পুত্র পুনরায় পিতার সম্রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যার্থ হন। ঠিক এরপরে জয়নাথ নামক এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে; যিনি সিংহাসনে বসেন। জয়নাথের পূর্ব পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
এরপর তিনি বিশাল এক সেনা বাহীনি গঠন করেন এবং কর্ণসুবর্ণ আক্রমণ করে দখল করেন। জয়নাথের মৃত্যুর পরে তিব্বত থেকে শাসকরা এসে বাংলা আক্রমণ ও দখল করতে থাকে।
উক্ত সকল ঘটনা প্রবাহ মাৎস্যন্যায়পূর্ণ অরাজক অবস্থা নির্দেশ করে, যা ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঘটে। মহাস্থানগড়ের বৈরাগির ভিটা খনন করে; পাল যুগ পূর্ব কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।
যেগুলো এই মাৎস্যন্যায় অবস্থাপূর্ণ সময়ের বলে ধারণা করা হয়। ফলে মহাস্থনগড়ের সেই ধ্বংসাবশেষকে উক্ত সময়ের বলে মনে করা হয়।
২। মাৎস্যন্যায় অবস্থা ও গোপালের আবির্ভাবঃ
৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দর এই আরাজকতাকে বারবার মাৎসন্যায় অবস্থাপূর্ণ বলার কারণ হলো, এই অবস্থা মাছের বৈশিষ্ট্যির সাথে মিলে যায়। কারন পানির রাজ্যে সর্বদা বড় মাছ রাজত্ব করে।
সেখানে বড় মাছেরা, ছোট ও দূর্বল মাছ খেয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ভাবে ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, বাংলায় দূর্বলের উপর সবলের অত্যচার চলে।
যা মাৎস্যন্যায় অবস্থাকেই নির্দেশ করে। এজন্য এই অরাজকতাকে মাৎস্যন্যায় অবস্থাপূর্ণ বলা হয়।
ঠিক এই মাৎস্যন্যায় অবস্থা ও দূর্বল শাসন ব্যবস্থা গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে শাসন ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেয়! খালিমপুর তাম্রলেখ অনুসারে, প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য নির্বাচন করে বলে মনে করা হয়।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, প্রকৃতিপুঞ্জ বলতে সাধারণ জনগণকে বোঝানো হয়েছে। ধারণা করা হয় এই প্রকৃতিপুঞ্জ কিংবা তৎকালিন সাধারণ জনগন; মাৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই গোপালকে শাসক হিসেবে নির্বাচন করে।
তবে, খালিমপুর তাম্রলেখের এই প্রকৃতি বা প্রকৃতিপুঞ্জের বিষয়ে অনেক ঐতিহাসিকগণ দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ মনে করা হয়, ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের প্রচীন এবং মাৎস্যন্যায় ও অরাজকতাপূর্ণ অবস্থায় সাধারণ জনগনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়।
আবার, অনেক ইতিহাসবিদের মতে, প্রকৃতি পুঞ্জ বলতে সাধারণ জনগণকে বোঝানো হয়নি। কেননা কৌটিল্যর অর্থ শাস্ত্রে, প্রকৃতি পুঞ্জ দ্বারা রাজ সভাসদ কিংবা মন্ত্রীপরিষদকে বোঝানো হয়েছে। এই মতে ধারণা করা হয় রাজ্যর সভাসদ গণের মাধ্যমেই গোপালকে শাসক মনোনীত করা হয়।
সুতরাং আমরা সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি উক্ত অরাজকতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবেই গোপালকে শাসক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
আর এভাবেই গোপাল বিনা যুদ্ধে ও বিনা বাধায় শাসন ক্ষমতায় আসিন হন! গোপালের প্রতিষ্ঠিত বংশ ও শাসন আমল পাল নামে পরিচিতি লাভ করে।
- আরো পড়ুন:
৩। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পরিচয়ঃ
গোপালের পরিচয় সম্পর্কে তেমন উল্লেখ্যযোগ্য কোনো তথ্য বা ইতিহাস জানা সম্ভব হয়নি। তবে সেই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজার প্রচলন ছিলো।
ধারনা করা হয়, গোপালও ছিলেন কোনো অঞ্চলের একজন সামন্ত রাজা। এছাড়া আরো ধারণা করা হয়, গোপাল হয়তো ভালো যোদ্ধ কিংবা সাহসী বীর ছিলেন যার ফলে প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে শাসন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য নির্বাচন করে।
গোপাল সম্পর্কে খালিমপুর তাম্রলেখ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেখান থেকে জানা যায় গোপালের পিতার নাম ছিলো ব্যপেট এবং পিতামহ বা দাদার নাম ছিলো দৈতবিঞ্চু, যার মানে সর্ববিদ্যা বিশারদ।
তাম্রলেখ থেকে পাওয়া গোপালের পিতা বা পিতামহের নামের আগে বা পরে কোনো রাজ উপাধি না থাকায় মনে করা হয় গোপাল কোনো রাজ বংশে জন্মগ্রহন করেননি।
সুতরাং ধারনা করা হয়, গোপালের জন্ম সাধারণ পরিবারে। তবে, তিনি হয়তো সামন্ত রাজা ছিলেন। কিন্তু সামন্ত রাজা বিশেষ বা উল্লেখ্যযোগ্য কোনো পদাধিকার নয়। সামন্ত রাজারা মূলত করের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল শাসনের দায়িত্ব পালন করতো।
৪। পাল বংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ
প্রকৃতিপুঞ্জ কর্তৃক গোপাল শাসক নির্বাচিত হন। এভাবে গোপাল ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায়, পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন! ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বছর বাংলায় পাল যুগের গৌরবময় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এই দীর্ঘ চারশো বছরে পাল বংশের মোট ১৭জন শাসকের পরিচয় পাওয়া যায়।
এই ১৭ জন শাসকের মধ্যে ধর্মপাল ও দেবপাল উল্লেখ্যযোগ্য। কেননা ধর্মপাল ও দেবপালের আমলেই পাল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।
এজন্য ধর্মপাল ও দেবপালকে পাল সাম্রাজ্যে উদীয়মান শাসক বলা হয়। সোমপুর মহাবিহারও এই ধর্মপালের আমলেই নির্মান করা হয়েছিলো।
সন্ধ্যাকরনন্দি রচিত- রামচরিতম্ গ্রন্থে, পালদের আদি ভূমি হিসেবে বরেন্দ্র ভূমিকে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
পাল রাজারা বরেন্দ্র ভূীমকে তাদের পিতৃ ভূমি মনে করতো! বরেন্দ্র ভূমি বর্তমানে রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চলের অন্তর্গত।
সুতরাং বলা যায় পালরা ছিলো বর্তমান বাংলারই অন্তভূক্ত।
৫। পাল বংশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাঃ
৪০০ বছরের পাল শাসন আমলে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা খুবই স্থিতিশী ছিলো। পাল যুগেই মাৎসন্যায় অবস্থার অবসান ঘটে।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, পাল সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর একটি নতুন জাতীয় জীবনের সূচনা ঘটে।
অর্থাৎ পাল শাসন আমালের পূর্বে বাংলা ক্ষুদ্র ক্ষদ্র জাতিতে এবং অঞ্চলে বিভক্ত ছিলো।
কিন্তু পাল শাসন আমলেই সমস্ত বাংলা একটি একক শাসনের অধিনে আসে।
যা কিনা পাল আমলের একটি গৌরবময় সাফল্য।
নিহাররঞ্জন রায় বলেন– পাল শাসন আমলে, দক্ষিন এবং দক্ষিন পূর্ব ভারত, সতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ঐক্যে আবদ্ধ হয়।
এর মাধ্যমে প্রতিয়মান হয় উক্ত সময়ে বাংলায় একটি কেন্দ্রীয় স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সুতরাং বলা যায়, বাংলার অরাজক অবস্থার পরে, স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার প্রতিষ্ঠা পালদের একটি গৌরবময় সাফল্য।
৬। পাল শাসন ব্যবস্থার ধরণ ও অবদানঃ
ইতিহাসবিদগণের মতে, পাল শাসন আসলে বাংলায় বড় ধরণের কোনো বৈদেশিক আক্রমন ঘটেনি। ফলে পাল শাসন আমলে যুদ্ধ কিংবা সৈন্য পরিচালনার পেছনে অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।
এজন্য পাল শাসকগণ প্রজা সেবার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। সুতরাং বাংলায় পাল শাসন আমল ছিলো প্রজাবৎসল ও জনকল্যাণকর গৌরবান্বিত শাসন আমল।
বিভিন্ন তাম্রশাসন থেকে জানা গেছে- ধর্মপাল ও দেবপাল প্রজাদের প্রচুর জলাশয় ও পুকর খনন করে দেন। কৃষি ভূমি দান করেছেন, কৃষির উন্নয়নের জন্য। দেবপালের তাম্রশাসন থেকে জানা গেছে, দেবপাল নগর নির্মান এবং নির্মানের জন্য অর্থ প্রদান করেন।
পাল শাসরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারনে, তারা শান্তিকামী ও কল্যাণকামী চিন্তা ধারার অনুগামী ছিলেন! যা বাংলার সার্বিক উন্নতি সাধনের পথ আরো সুগম করে, এবং একটি গৌরবদীপ্ত শাসন ব্যবস্থার খেতাব অর্জন করে।
৭। বাংলায় পাল শাসন আমলে সাহিত্যে অবদানঃ
পাল শাসন আমলে একই সাথে, বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্যর চর্চা সহ বেশ গৌরবময় উন্নতি সাধন হয়। এসময়ে গৌড় রীতির উন্নতি সাধন হয়। এছাড়াও, এই আমলে, সাহিত্য, চিকিৎসা সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়।
পাল আমলে রচিত গন্থের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, সন্ধ্যাকরনন্দী রচিত, রামচরিতম, শ্রীধর ভট্র রচিত ন্যায় কুন্ডলি। এছাড়া, চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত গ্রন্থ হলো, চক্রপাণি দত্তের চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদ দীপিকা, ভানুমতী, শব্দ চন্দ্রিকা গ্রন্থ। জীমূতবাহনের দায় ভাগ, ব্যবহার মাত্রিকা, কাল বিবেক উল্লেখ্যযোগ্য।
উক্ত গ্রন্ত সমূহ রচনার মাধ্যমে প্রতিয়মান হয় যে সাহিত্য ক্ষেত্রেও পাল যুগ গৌরবময় সাফল্যের অধিকারি ছিলো।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের চর্চা এবং রচনা, এই পাল আমলেই হয়েছিলো। মূলত পাল শাসকদের পৃষ্ঠ পোষকতায় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পন্ডিতগণ(লুই পা, কাহ্ন পা, ইত্যাদি) চর্চাপদ রচনা করনে।
মাগধী-প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব শুরু হয়েছিলো এই পাল আমলেই। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে- ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বাংলায় পাল যুগের শাসন আমল গৌরবময় সাফল্যর স্বাক্ষর রাখতে সামর্থ্য অর্জন করে।
৮। শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় পালদের অবদানঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারনা, পাল যুগেই সর্ব প্রথম প্রকাশ পায়। দেখা যায় শিক্ষা বিস্তারে কাজে বিভিন্ন বিহার ব্যবহার করা হতো। এই বিহাড় সমূহ একই সাথে শিক্ষা বিস্তার এবং ধর্ম চর্চার কাজে ব্যবহার করা হতো।
সোমপুর মহাবিহার, নালন্দা মহাবিহার, বিক্রমশীল বিহার উল্লেখ্যযোগ্য ভাবে শিক্ষা ও ধর্ম চর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলো।
ধর্মপলের আরেক নাম বিক্রমশীল দেব। তার নামানুসারে বিক্রমশীলা বিহারের নাম করণ করা হয়।
আবার সোমপুর মহা বিহারও ধর্মপালের আমলে তৈরি। বর্তমানে, নালন্দা মহাবিহারকে সর্বপ্রচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বিক্রমশীলা বিহারে তিব্বতীয় ভাষার চর্চার কথা জানা গেছে। ধরাণা করা হয়, তিব্বতীয় ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থ, সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ হতো কিংবা সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ হতো! এর মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের বিশেষ দ্বার উন্মোচিত হয়।
অতিশদীপঙ্কর, রাহুভদ্র সহ বিভিন্ন পন্ডিতের নাম পাওয়া যায় যারা, এই বিহার সমূহে শিক্ষা দান করতেন। সুতরাং শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় পাল যুগ গৌরবময় সফলতার দাবি রাখে।
৯। স্থাপত্য ক্ষেত্রে বাংলায় পাল যুগের সাফল্যঃ
সোমপুর বিহার, বিক্রমশীলা বিহার, ধর্মীয় মঠ, পাল শাসন আমলের উল্লেখ্যযোগ্য স্থাপত্য শিল্পের উদাহরণ। সোমপুর মহাবিহার গঠন শৈলির দিক থেকে ছিলো একদম সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যর অধিকারি।
সোমপুর বিহারে, টাালি, পোড়ামাটির ফলক, চিত্র ব্যবহার করে অন্যন্যা রুপ দেয়া হয়েছিলো।
সেই সোমপুর বিহারে ছোট ছোট অনেক কামরা দেখা যায়, সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতো।
এছাড়া এই বিহারগুলোতে পয়ঃনিষ্কাশন; উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিহারের ভেতরে মন্দিরের ন্যায় উঁচু স্ট্রাকচার দেখা যায়।
আবার সোমপুর বিহারের গায়ে, ফুল, লতা, পাতা সহ বিভিন্ন ডিজাইন দেখা যায়! উন্নত গঠন শৈলীর এসব গৌরবময় ঐতিহাসিক স্থাপনা বিশ্লেষন করে বলা যায়, পাল যুগ স্থাপত্য শিল্পেও সফল ছিলো।
১০। ভাস্কর্যর ও চিত্র শিল্পে পালদের অবদানঃ
পাল যুগে ধিমান এবং দেবপালের মাধ্যমে ভাস্কর্য ও চিত্র শিল্পের বিশেষ বিকাশ ঘটে। সেই সময়ে, পাথরে খোদাইকৃত বিভিন্ন মুর্তি পাওয়া যায়! মুর্তি গুলোর বেশির ভাগই মানুষের আকৃতিতে তৈরি ছিলো। সোমপুর মহাবিহারের কুঠুরিতে মুর্তি পাওয়া যায়।
উন্নত মুর্তি বানাতে কষ্টি পাথর কিংবা আরো দামি পাথর কিংবা ধাতু ব্যবহার করা হতো। উল্লেখ্যযোগ্য মুর্তির মধ্যে রয়েছে- মহীপালের সময়ে তৈরি, বাঘাউর বিঞ্চু মুর্তি, ৩য় গোপালের আমলে তৈরি সাদা শিব মুর্তি যা বর্তমান সময়েও টিকে রয়েছে।
সুতরাং বলা যায়, ভাস্কর্য ক্ষেত্রেও পাল যুগের সফলতা ছিলো।
বাংলায় অনেক আগেই মৃৎ শিল্পের বিকাশ ঘটে। মাটির তৈরি এসব জিনিস দিয়ে আসবাব পত্র কিংবা ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটানো হতো।
কিন্তু মৃৎ শিল্পের গায়ে চিত্র আঁকার প্রচলন প্রথম শুরু হয় এই পাল আমলেই। চিত্র অঁঙ্কনে রং তুলি ব্যবহার করা হতো।
সুতরাং পাল যুগ চিত্র শিল্পেও গৌরবন্বানিত সফলতার দাবি রাখে।
১১। বাংলায় পাল যুগের শাসন আমলের অর্থনীতিঃ
কৃষি ব্যবস্থাঃ
পাল আমলে বাংলার সাধারণ মানুষের কৃষিই ছিলো জীবিকার প্রধান উৎস।
কৃষি পণ্য হিসেবে পাল আমলে ধান, গম, আম, আখ ও তুলা বেশি চাষ হতো।
আম এবং আখ চাষের বর্ণনা পাওয়া যায় বেশি।
যা থেকে ধারনা করা হয় পালরা বেশির ভাগ বরেন্দ্র এলাকার অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
শালি নামক এক প্রকারের ধান উৎপাদনের বর্ণনা পাওয়া যায়। বাংলার বাহিরেও এই শালি ধানের খ্যাতি ছিলো।
পাল রাজা কর্তৃক খননকৃত পুকুর ও জলাশয়ে মাছ চাষ করা হতো এবং আমের চাষ হতো প্রচুর পরিমানে।
পাল আমলে বাংলায় পুুন্ডি নামক এক ধরনের আখ চাষ করা হতো।
ধারনা করা হয় পুন্ডি নামক এই আখ চাষের কারনেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিলো পুন্ড্রনগর।
এছাড়া মার্কপলো এবং চর্যাপদ থেকে বাংলায় পাল আমলে তুলা চাষের বর্ণনা পাওয়া যায়।
সুতরাং কৃষি ক্ষেত্রে পাল আমলে, বাংলায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও গৌরবময় অবস্থা বিরাজমান ছিলো।
বাংলায় পাল যুগের শাসনকালে শিল্প ব্যবস্থাঃ
আদিকাল থেকেই বস্ত্র শিল্পের জন্য বাংলা বিখ্যাত।
তবে, মিহি কাপড় উৎপাদনের জন্য পাল যুগের বেশ সাফল্য ও খ্যাতি দেখা যায়।
মিহি কাপড়ের পাশাপাশি মোটা কাপড়েরও প্রচলন ছিলো তবে মিহি কাপড়ের কদর ছিলো বেশি।
মিহি কাপড়ে মধ্যে রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত মসলিন।
বাংলার বাহিরের লোকজন এবং ভিন্ন পর্যটক মিহি কাপরের বেশ প্রশংসা ও কদর করতেন।
আবার চর্যাপদে (তন্তিপদ) তাঁত শিল্পের বর্ণনা পাওয়া গেছে।
এছাড়া বাংলায় উৎপাদিত আখ থেকে চিনি উৎপাদন হতো এবং সমুদ্র মোহনা অঞ্চলে প্রচুর লবণ চাষ হতো।
সুতরাং পাল আমলে তাঁত শিল্প, চিনি ও লবণ শিল্পের বিশেষ খ্যাতি ও গৌরবদীপ্ত সফলতা ছিলো।
পেরিপ্লাসের মতে, গঙ্গার মোহনায় প্রচুর মুক্তা পাওয়া যেতো।
বিহারে সোনার খনির উল্লেখ্য রয়েছে। সুতরাং পাল আমলে অলংকার তৈরি এবং ব্যবহার হতো।
সেই সময়ে, লোহার, সরঞ্জাম, অস্ত্র, অলংকার তৈরি করা হতো।
তাই বলা যায় পাল আমলে বাংলা, ধাতু ও অলংকার ব্যবহারেও বেশ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
ব্যবসা বাণিজ্যঃ
পাল আমলে অভ্যন্তরিন বাণিজ্য চলমান ছিলো।
স্বর্ণ ও রুপ্য মুদ্রার পরিবর্তে কড়ির বিনিময়ে পণ্য আদান-প্রদানের প্রমান পাওয়া যায়।
বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যর জন্য স্বর্ণ কিংবা রুপার মুদ্রার প্রয়োজন।
কিন্তু স্বর্ণ ও রুপার মুদ্রার অপর্যাপ্ততাকে, বৈদেশিক বাণিজ্যর অনঅগ্রগতির জন্য দায়ি করা হয়।
মূলত, মুদ্রার মান, বন্দর ব্যবস্থপনার ঘাতটির জন্যই বৈদেশিক বাণিজ্যতে পাল আমলে বাংলা তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
কিন্তু পাল আমলে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্যতে তেমন সফলতা দেখা না গেলেও স্থানীয় ব্যবসা-বানিজ্যতে অবাধ স্বাধীনতা ও সুযোগ ছিলো।
কৃষকের ফসল কেনা বেচার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ, কড়ির আদান প্রদান থেকে বোঝা যায় বাংলায় পাল যুগের শাসন আমলে বাণিজ্য ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধপূর্ণ ও সাফল্যমন্ডিত অবস্থা বিরাজমান ছিলো।
কিছু প্রশ্ন ও উত্তর:
গোপাল।
বাংলা, বিহাড় ও উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চলে।
প্রায় ৪০০ বছর।
৭৫০ থেকে ১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ।
১৭ জন।