মানব সভ্যতা বিকাশে মিশরীয় সভ্যতাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা হিসেবে মনে করা হয়! মূলত ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্ব রাজবংশীয় যুগ থেকে মিশরীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদ্ধতিকে একত্রিত করে মিশরীয়রা এক উন্নত সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায়।
যখন, রাজাকে ফারাও বা ফেরাউন বলা হতো এবং রাজা নিজেই নিজেকে সূর্যদেবতা বা রে এর পুত্র বলে মনে করতেন ঠিক তখন নীল নদের অববাহিকায় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
হয়তো এজন্যই ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস মিশরীয় সভ্যতাকে নীলনদের দান বলে অভিহিত করেন।
মানব সভ্যতা বিকাশে মিশরীয় সভ্যতার অবদান সমূহঃ
মানব সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে! তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, দর্শন, গণিত শাস্ত্র, থেকে শুরু করে কৃষি পর্যন্ত সকল মৌলিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এখন আমরা, মিশরীয় সভ্যতার ১৮টি বিশেষ অবদান নিয়ে আলোচনা করবো।
১। সরকার পদ্ধতিতে মিশরীয়দের অবদান:
প্রাচীন মিশরীয় সরকার ব্যবস্থাপনাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে প্রাচীন রাজবংশীয় যুগের সরকার পদ্ধতি এবং অপরটি হলো সাম্রাজ্য যুগের সরকার পদ্ধতি।
প্রাচীন রাজবংশীয় যুগের সরকার পদ্ধতিতে দেখা যায় মিশরের প্রাচীন রাজবংশের সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামো ছিল পুরোহিত কেন্দ্রিক কিংবা একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্র।
যেখানে রাজা সূর্য দেবতা বা রে এর পুত্র এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ক্ষমতা পালন করতেন এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী হতেন এবং নিজেকে ফারাও নামে পরিচয় দিতেন।
অপরদিকে সাম্রাজ্য যুগের সরকার পদ্ধতিতে জাতীয় ঐক্যের চেয়ে ফারাওদের শাসনের মূল ভিত্তি ছিল সামরিক শক্তি।
তখনকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কথা জানা না গেলেও, সমস্ত সাম্রাজ্য কে কয়েকটি প্রশাসনিক ভাগে ভাগ করে শাসনের জন্য, ফারাও কর্তৃক গভর্নর নিয়োগ দেয়া হতো।
২। সামাজিক ক্ষেত্রে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
প্রাচীন মিশরীয় সমাজ ধর্মীয় অনুশাসনের আদলে পরিচালিত হতো। তারা বিভিন্ন ধরনের দেব দেবীকে বিশ্বাস করত।
যেমন সূর্য দেবতা বা রে, ওসিরিস, নীলনদের দেবতাকে মান্য করতো! এছাড়ও, তারা পরকালে পাপ-পুণ্যের হিসেবে বিশ্বাস করত।
আত্মার অমরত্বতে বিশ্বাস করতো। ফলে তারা মমি শিল্পের বিকাশ ঘটায়।
এছাড়াও প্রাচীন মিশরের সমাজে দুই ধরনের সামাজিক বৈষম্য মূলক শ্রেণি ছিলো। একটা হচ্ছে দাস শ্রেণি এবং অন্যটি হচ্ছে স্বাধীন শ্রেণি।
দাস শ্রেণীর মধ্যে ভূমিদাস, ক্রয়কৃত দাস ও গরিব কৃষক অন্তর্গত ছিলো। দাসদের চেয়ে ভূমি দাসদের অবস্থা একটু উন্নত ছিল।
আবার গরীব কৃষকদের অবস্থাও দাসদের চেয়ে উন্নত ছিলো। কিন্তু দাসদের অবস্থা ছিল সমাজের সকল শ্রেণীর নিম্নে।
অপরদিকে, স্বাধীন শ্রেণীর মধ্যে ছিল রাজ পরিবার। এছাড়ও পুরোহিত শ্রেণি, রাজ কর্মচারী, অভিজাত শ্রেণী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও পেশার সৈনিক, এই স্বাধীন শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
৩। কৃষিতে মিশরীয়দের অবদান:
নীলনদে উঁচু বাঁধ দিয়ে উন্নত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে মিশরীয়রা কৃষির যুগে প্রবেশ করে। কৃষির উপর ভিত্তি করে প্রাচীন মিশরীয় অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল।
নীলনদের অববাহিকায় তৎকালে মিশরীয়রা তাদের উর্বর ভূমির উপর সেচ নির্ভর উন্নত কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসল ফলাতে সক্ষম হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০০ অব্দে তারা লাঙ্গলের ব্যবহার শুরু করে। এভাবে তারা কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান করে ও উন্নয়ন সাধন করে।
তাদের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ছিল তুলা, গম, জব, পেঁয়াজ, বার্লি, সহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ও ফলমূল।
তাছাড়াও অর্থকরী ফসলের মধ্যে ছিল কার্পাস তুলা, পাট ও এক প্রকার শাল জাতীয় তন্তু।
৪। মানব সভ্যতা বিকাশে ব্যবসা-বাণিজ্যতে মিশরের অবদান:
প্রাচীন মিশরের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক উন্নতি করেছিল। যা ছিল তাদের অর্থনীতির এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ফারাওদের আমলে ভূমধ্যসাগরে চলাচলের উপযোগী মালবাহী জাহাজ, মিশরীয় সভ্যতার মানুষ সর্বপ্রথম তৈরি করেছিল।
প্রধানত চারটি পথে তাদের জাহাজ নীলনদ ধরে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, মেহগনি কাঠ, হাতির দাত সংগ্রহ করে আনতো।
এছাড়াও ইজিয়ান দ্বীপ, ক্রিট, ফিনিশিয়া, প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার সাথে মিশরের বাণিজ্য চলত।
তাদের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল গম, লিনেন কাপড়, মৃৎপাত্র, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রভৃতি দ্রব্য।
অন্যদিকে আমদানি দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য, হাতির দাঁত, উট, ধাতু নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি।
৫। শিল্পক্ষেত্রে মিশরী সভ্যতার অবদান:
খনি শিল্প, ধাতু শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, মাটির পাত্র তৈরি, সুতি বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, আসবাব শিল্প, পাথর শিল্প ইত্যাদিতে মিশরীয়দের বিশেষ অবদান ছিল।
অবশ্য নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে তারা ক্রমশ আরো কারখানা গড়ে তুলতে থাকে! যেখানে ২০ বা ২৫ বা তার বেশি লোক কর্মে নিয়োজিত থাকতো।
৬। লিখন পদ্ধতিতে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
মানব সভ্য়তায় মিশরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার! মিশরীয়রা চিত্রলিপি উদ্ভাবন করে।
ধীরে ধীরে এই লিপির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ পেতে থাকে এবং সর্বাধিক যুক্ত অক্ষরের শব্দ তৈরি হতে থাকে এবং মনের ভাব প্রকাশের জন্য চূড়ান্তভাবে তারাই সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করে।
অবশ্য প্রথমদিকে মিশরীয়দের মধ্যে স্বরবর্ণ এর প্রচলন ছিল না। শুধু ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বারা ধ্বণি প্রকাশের চেষ্টা করা হতো।
মিশরীয়দের লিখন পদ্ধতি চিত্র নির্ভর ছিলো। যাকে হায়ারোগ্লিফিক বলা হতো।
এই হায়ারোগ্লিফিক লিখন পদ্ধতি, তার চারিত্রিক দিক থেকে তিনটি রূপ লাভ করেছিল। এক- চিত্রভিত্তিক লিপি, দুই- অক্ষরভিত্তিক লিপি এবং তিন- বর্ণভিত্তিক লিপি।
সুতরাং ঐতিহাসিক ডেভিসের ভাষায় মিশরীয়রাই প্রথম লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। যাকে মানব সভ্যতা বিকাশে এক বড় অবদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
৭। মানব সভ্যতা বিকাশে শিক্ষায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
মানব সভ্যতার শুরুতে মিশরীয়রা সর্বপ্রথম শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। রাজা ও জমিদার নির্ভর এ সরকার ব্যবস্থায় দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা পণ্ডিতের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসত।
সে সময় মূলত হিসাব-নিকাশে, শুধু অংক শিক্ষা দেয়া হতো বেশি যেন শিক্ষিত ছাত্র রাজা ও জমিদারদের গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্য সম্পত্তির হিসাব নিকাশ এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সুদক্ষ পন্ডিত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হতে পারেন। তখন শিক্ষার মাধ্যম ছিল চিত্রলিপি।
৮। কাগজ কলম এর ব্যবহারে মিশরীয়দের অবদান:
লিখিত পদ্ধতির আবিষ্কার এর পাশাপাশি তৎকালীন মিশরীয়রা লেখার জন্য কাগজ হিসেবে প্যাপিরাস নামক এক প্রকার গাছের ছাল ব্যবহার করত।
কলম হিসেবে তারা এক ধরনের নলখাগড়া ব্যবহার করত এবং তারা কালি হিসেবে ব্যবহার করত এক প্রকার গাছের রস বা আঠা।
সুতরাং বলা যায় কাগজ-কলমের ব্যবহারেও মিশরীয় সভ্যতার বিশেষ অবদান রয়েছে।
৯। সাহিত্য ক্ষেত্রে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
পিরামিড, মন্দির ও সমাধির গায়ে মিশরীয়রা তাদের দর্শন ভিত্তিক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রেখে যান! তাদের সাহিত্যকর্ম ছিল প্রধানত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর।
এছাড়া ধর্মীয় ও যাদুর শ্লোক, পৌরাণিক রূপ কথার কাহিনী ছিল তাদের সাহিত্যের মূল উপজীব্য।
এর পাশাপাশি ভ্রমণ বৃত্তান্ত সহ বিভিন্ন বিষয় ছিল তাদের সাহিত্যের অংশ।
এসময়কার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হচ্ছে; দি বুক অফ দি ডেড, মেসফিট ড্রামা, রয়েল সান, হাইসন অফ ইখনাটন ইত্যাদি।
১০। দর্শনের ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
প্রাচীন মিশরীয়রা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নৈতিকতা দর্শনে চর্চা করতেন বলে, তারা দর্শন শাস্ত্রেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন।
মানুষের উত্থান-পতন, চিরন্তন পৃথিবী, ঘটনার পুনরাবৃত্তি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সহ প্রভৃতি ছিল তাদের দর্শন চর্চার মূল বিষয়।
এছাড়াও ভালো-মন্দ, অনাচার, পরকাল প্রভৃতি বিষয়ে দর্শন শাস্ত্রে তারা আলোচনা করত।
১১। মানব সভ্যতা বিকাশে স্থাপত্য শিল্পে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতা কে বলা হয় শ্রেষ্ঠ নির্মাতা। কেননা; তাদের প্রথম পরিচিতি ঘটে স্থাপত্য তথা পিরামিডের হাত ধরে।
স্থাপত্য শিল্পতে দক্ষ প্রকৌশলী জ্ঞানের মাধ্যমে মিশরীয়রা আকাশচুম্বী পাথরের সৌধ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়।
তাদের স্থাপত্য নির্মাণের প্রধান উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ বা পিরামিড ও ধর্ম মন্দির সমূহ।
সর্বপ্রথম ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে রাজা জোসার সাক কারাই, বহু স্তর বিশিষ্ট পিরামিড নির্মাণ করেন। যেখানে; ফেরাউনের মমি রাখা হতো।
এছাড়া মিশরের স্থাপত্য শিল্পের মধ্যে ছিল বিশাল ইমারত, মন্দির ও মূর্তি।
১২। ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
উন্নত যন্ত্রপাতি ও দক্ষতার মাধ্যমে মিশরীয় স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে উৎকর্ষতার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়।
বড় বড় পাথর কেটে তারা চমৎকারভাবে মূর্তি তৈরি করতে পারত! এদের মধ্যে বহুখন্ড পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তোলা ভাস্কর্য স্ফিংস ছিল এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
তারা বিভিন্ন দেবদেবীর বিশাল বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পারতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফেরাউনের ভাস্কর্য, তাছাড়া ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস, ফারাও ইখনাটন ও তার রানির ভাস্কর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন মিশরীয় ভাস্কর্য কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য ও অপরটি পাথরে খোদাই করা নকশা।
১৩। চিত্রকলায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
সমাধি ও মন্দির সমূহের দেওয়ালে সাধারণত সাদা ও কালো রঙের ব্যবহার করে মিশরীয়রা চিত্র অংকন করতো।
এছাড়া ধারণা করা হয় প্রাচীন মিশরীয় তাদের চিত্রশিল্পের বিকাশ ঘটায় বিভন্ন মন্দিরের গায়ে।
মন্দিরের দেয়াল এবং পিরামিড এর অভ্যন্তরে আঁকা ধর্মীয় ধারণা প্রসূত ছবিগুলো চিত্রশিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
১৪। ক্ষুদ্র শিল্পে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রেও মিশরীয়রা অসাধরন কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।
দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কুটির শিল্প ও নকশা ওয়ালা কাপড়, কম্বল, পর্দা, মৃৎশিল্প সহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করতে তারা সক্ষম ছিল।
এছাড়া তারা মূল্যবান আঁংটি, মালা ও মুকুট তৈরি করতে পারত।
১৫। গণিত শাস্ত্রে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
মিশরে গণিত শাস্ত্র চর্চার ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। মিশরের গণিত চর্চা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি কয়েকটি প্রাচীন মিশরীয় পাণ্ডুলিপি থেকে।
মস্কোতে সুরক্ষিত প্যাপিরাস এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত রাইন্ড প্যাপিরাস বা আহমেদ প্যাপিরাস থেকে গণিত চর্চার উপকরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
মিশরীয়দের অংক পাতন পদ্ধতি ছিল দশমিক বা তারা এক, দশ, শতক, সহস্র সহ বিভিন্ন সংখ্যা নির্দেশ করতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করত।
তারা এক, দশ, একশ এর মধ্যে সংখ্যা লেখার জন্য একই প্রতীককে বারবার লিখতো। তারা যোগ বিয়োগ গুন ভাগ, এসকল গাণিতিক প্রক্রিয়া সাথে বেশ পরিচিত ছিল।
তবে তাদের গুণের পদ্ধতি ছিলো একটু আলাদা ধরনের।
তারা দশমিক হিসাব জানলেও মানের হিসাব আবিষ্কার করতে পেরেছিল না। তারা ভগ্নাংশের সাথে পরিচিত ছিলো তবে তারা আমাদের মতো অনায়াসে ভগ্নাংশ লিখতে পারতো না।
একাংশ ছাড়া ভগ্নাংশ তাদের কাছে অর্থ পূর্ণ ছিল না! তাই তারা ভগ্নাংশের কতগুলো তালিকা ব্যবহার করত।
এছাড়াও মিশরীয়রা জ্যামিতিতে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিল। পিরামিড নির্মাণ, খাল খননে, জমির হিসাব সংরক্ষণে, ভূমির পরিমাপ ও আয়তন মাপার দরকার হতো বলে তারা জ্যামিতির ব্যবহার করতো।
এসব থেকে উদ্ভব ঘটেছিল গণিত শাস্ত্রের। যে শাখায় ভূমি ও জমি সংক্রান্ত হিসাব করা হতো তার নাম দেয়া হয়েছিলো জ্যামিতি।
আর জ্যামিতি শব্দের অর্থ হলো ভূমির পরিমাপ। তারা ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বহুভুজ, বৃত্তের ক্ষেত্রফল এবং সিলিন্ডার সহ পিরামিডের ঘনফল নির্ণয় করতে পারতো। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত তারা সহজে বের করতে পারত।
১৬। মানব সভ্যতা বিকাশে বিজ্ঞানে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মিশরীয়রা যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করেছিল।
তাদের বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে অন্যতম ছিল জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান! তবে তারা বিজ্ঞানের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে যথেষ্ট মেধা ও মানসিকতার পরিচয় দেয়।
১৭। জ্যোতির্বিদ্যায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
মিশরীয়দের কেউ অবশ্য বিশুদ্ধ বিজ্ঞানী ছিলেন না। এজন্য বিশ্বজগতের প্রকৃত চিত্র জানার জন্য তারা কখনো চেষ্টা করেনি।
ফলে জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে তারা বেশি সাফল্য লাভ করতে পারে নি। তবে তারা সৌর পঞ্জিকার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।
লুব্ধক নক্ষত্রের আবির্ভাব কাল পর্যবেক্ষণ করে তারা ৩৬৫ দিনে বছর গণনার রীতির প্রচলন করে! তার আগে মিশরীয়রা চন্দ্রমাস ভিত্তিক হিসাব রাখতো; কিন্তু এতে একটু সমস্যা হয়েছিল।
তারা ধ্রুব নক্ষত্রের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে, পূর্বমুখী মন্দির বা পিরামিড নির্মাণ করতো। তারা নক্ষত্রের গতি পর্যবেক্ষণের জন্য সরল ধরনের সুন্দর যন্ত্রের উদ্ভব করেছিলো।
একটা খেজুর পাতার মাঝখানে খানিকটা অংশ লম্বালম্বি কেটে, তার ফাক বরাবর একটা লম্বা সুতা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো এবং একটা নক্ষত্র যখন এ সূতাটিকে অতিক্রম করত তখন সে সময়কে লিপি বদ্ধ করা হতো।
এছাড়াও মিশরীয়রা দিনের আলোর ছায়া মেপে সময় নিরূপণের জন্য ছায়া ঘড়ি বা সূর্য ঘড়ি আবিষ্কার করতেও সক্ষম হয়।
১৮। মানব সভ্যতা বিকাশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে মিশরীয় সভ্যতার অবদান:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে মিশরীয়রা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। প্রথম পর্যায়ে তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত ধারণা কুসংস্কারচ্ছন্ন ছিল।
পরে ধীরে ধীরে তা বিজ্ঞান সম্মত হয়। তারা ১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।
তৃতীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জোসার এর উজির ছিলেন প্রাচীনতম চিকিৎসক। তিনি একাধারে ছিলেন জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসক ও স্থপতি।
চিকিৎসা বিদ্যায় তার দক্ষতা এত পরিমাণে বৃদ্ধি পায় যে পরবর্তীতে তাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হতো।
পিরামিডের যুগে মিশরের অনেক চিকিৎসক এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এসময় মিশরের চক্ষুরোগ, পেটের রোগ, দাঁতের রোগ ও শূল্যচিকিৎসার প্রচলন ঘটে।
হৃদপিণ্ড ও নাড়ির তাৎপর্য তারা আবিস্কার করতে সক্ষম হয়।
ভাঙ্গা, মচকানো এমনকি ছোট ছোট অপারেশনও তারা করতে পারত।
মিশরীয় চিকিৎসকগণ রোচক ঔষধ উদ্ভাবন করে এবং অনেক ওষুধের গুনাগুন লিপিবদ্ধ করেন।
তারা মেটেরিয়া মেডিকা বা ওষধের তালিকা প্রনয়নের কাজ করেন।
মিশরীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বড় আবিষ্কার হলো মমি তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করা। মমি তৈরির ধ্যান-ধারনা ধর্মীয় ধারা থেকে এসেছে।
তবে তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা থেকে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সুতরাং বলা যায় মানবসভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মিশনারীদের অবদান অবিস্মরনীয় ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো।