বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত এবং তাঁর দার্শনিক মতবাদ সমূহ

আমরা আলোচনা করবো, মধ্যযুগের বিখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত এর জীবনী এবং তার সমস্ত দার্শনিক মতবাদ নিয়ে।

এই পর্বে আমরা তার জীবনী, পেশা জীবন, তার রচিত বই তার বিভিন্ন মতবাদ, তত্ত্ব এবং রেনে দেকার্তের অবদান সহ দেকার্তের উপর সম্ভাব্য ৪০টি প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো।

দার্শনিক রেনে দেকার্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

রেনে দেকার্ত (Rene Descartes) ফ্রান্সের টুরাইন প্রদেশের ল্যা হ্যাই (La Haye) নামক সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ৩১ শে মার্চ ১৫৯৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। দেকার্তের বাবা ছিলেন পেশায় একজন ‍ডাক্তার এবং পার্লামেন্টের সদস্য।

জন্মের সময়ই রেনে দেকার্ত তার মাকে হারান! ছোট বেলা থেকেই দেকার্ত ছিলেন দূর্বল ও রোগা প্রকৃতির! তার ৮ বছর বয়সে তিনি জেস্যুইট স্কুলে (Jesuit school) ভর্তি হন। এই জেস্যুইট স্কুলটি ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ের জন্য ৪র্থ হেনরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন! এই স্কুল থেকেই রেনে দেকার্ত পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন আদব কায়দা নিয়মশৃঙ্খলা ও সামাজিক শিষ্ঠাচার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন।

দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য তিনি নিয়মিত প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারতেন না। তবে, তার স্কুলের কর্তৃপক্ষ তা জানতো যে তিনি দূর্বলতার কারণেই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন! এজন্য তারা দেকার্তকে কিছু বলতো না! এভাবে আস্তে আস্তে তার এই দেড়িতে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস, তার স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

দেকার্ত ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন অনেক মেধাবী! সেই সময় থেকেই তার গণিত ও জ্যামিতির উপর বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। স্কুলে আট বছর পড়াশোনা করার পরে তিনি গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে এক বছর কাটান।

তার বাবার অনেক অর্থ সম্পদ ছিলো বিধায়, তার বাবা তাকে প্রচুর টাকা দিয়ে এবং তার পড়াশোনার জন্য, একজন গৃহভৃত্য দিয়ে প্যারিসে বসবাস করার জন্য পাঠিয়ে দেন। প্যারিসে আসার পরে রেনে দেকার্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ পেয়ে যান তবুও তিনি কখনো বিশৃঙ্খল জীবন-যাবন করেননি।

তিনি সর্বদা সংযমী ও সৎ জীবন-যাপন করেছেন। তবে; জুয়া খেলার প্রতি দেকার্তের বিশেষ আকর্ষন ছিলো! তিনি একটু মৃতব্যয়িতার সাথে চলতেন বলে, তার এই জুয়া খেলাকে কেউ খারাপ বলেনি!

ছোট বেলো থেকেই রেনে দেকার্ত একা থাকতে ভালোবাসতেন। তবে, একা থাকলেও তিনি কখনো সময় অপচয় করেননি! তিনি তার এই একাকী সময়কে পড়াশোনা ও দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে ব্যয় করতেন। তার এই কাজে তাকে সাহায্য করতেন, তারই সহপাঠী, প্রখ্যাত ধর্মযাজক ও গণিতবিদ মেরসেন ! এভাবে তিনি তার শৈশব ও শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেন।

দার্শনিক রেনে দেকার্তের সংক্ষিপ্ত পেশাজীবন:

একাকী জীবন যাপনের অভ্যাস থাকলেও, বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের বড় রকমের শখ ছিলো দেকার্তের মধ্যে! আর তিনি এটাও জানতেন যে সৈনিকের চাকরি নিতে পারলে, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করা তার জন্য অনেক সহজ হবে। এজন্য দেকার্ত ম্যাওরিস অব নাসুর অধিনে সৈনিক পদে চাকরি গ্রহণ করেন! এভাবে রেনে দেকার্ত কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন।

স্পেনের কাছে থেকে স্বাধীন হওয়ার পরে, হল্যান্ড ছিলো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও সভ্য দেশ! ম্যাওরিস নামক যে ব্যক্তির অধিনে দেকার্ত চাকার নিয়েছিলেন, সেই ম্যাওরিস ছিলেন অনেক উদারনৈতিক এবং যুদ্ধবিদ্যার পাশাপাশি তিনি গনিত ও বিজ্ঞানের প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন।

এজন্য ম্যাওরিসের সাথে একদল প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর যোগাযোগ ছিলো আর সেখানেই রেনে দেকার্ত ২ বছর কাটান! এসময়, দেকার্ত গনিত ও সংগীত বিষয়ে কিছু রচনাবলী, প্রাথমিক ভাবে রচনা করেন। ঠিক এই সময়ই দেকার্ত বুঝতে পেরেছিলেন বীজগণিতকে জ্যামিতিতে প্রয়োগ করার সম্ভাবনা এবং এর পরে তিনি বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতি আবিষ্কার করেছিলেন।

বোহেমিয়ার প্রোটেস্টান্টদের বিদ্রোহের কারণে ১৬১৯ সালে একটি যুদ্ধ বেধে যায়! ঠিক তখন দেকার্ত ক্যাথলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ক্যাথলিকরা এই যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং এর পরে রেনে দেকার্ত তাদের সাথে প্রাগে যান।

কিন্তু, এক সময় সৈনিক জীবনের আনন্দ হারিয়ে দেকার্ত আবার প্যারিসে চলে যান! এরপরে ৩ বছর সেখানেই কাটান। প্যারিসের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় দেকার্তের প্রতি অনেক আকৃষ্ট ছিলো! কিন্তু, তিনি একা থাকতে পছন্দ করতেন বলে, কারো সাথে সঙ্গ দিতেন না কারণ এতে তার জ্ঞান চর্চার কাজে বিঘ্ন হতো! এই কারনে, দেকার্ত প্যারিস ত্যাগ করেন! এভাবে তিনি মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকার চেষ্টা করতেন।

১৬২৮ সালে রেনে দেকার্ত হল্যান্ড যান। সেখানে গিয়েও তিনি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতেন! এজন্য হল্যান্ডে একবার তার বাসা পরিবর্তন করেন। এখানেই তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শরীরবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা সহ তার পছন্দনীয় বিভিন্ন বিষয়ে নিবিরভাবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ পান।

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্তের রচিত বিখ্যাত বই:

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত উল্লেখ্য যোগ্য কিছু বই রচনা করেন। তিনি দর্শন শাস্ত্র, গণিত ও জ্যামিতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। ১৬৩৭ সালে একই সঙ্গে চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘জিয়োমেট্রি’, ‘ডায়োপট্রিকস’ ‘মেট্রোলজি’ এবং আলোচিত ‘ডিসকোর্স অন মেথড’। তার উল্লেখ্যযোগ্য বই হলোঃ
১। ডিসকোর্স অন মেথোড – ১৬৩৭ সাল (Discourse on Method)
২। দি মেডিটেশন অন দি ফার্স্ট ফিলোসোফি – ১৬৪১ সাল (the Meditations on the First Philosophy)
৩। দি প্রিন্সিপাল অব ফিলোসোফি – ১৬৪৪ সাল (the Principles of Philosophy)
৪। The Treatise on the Passions-1650.

দার্শনিক রেনে দেকার্তের মৃত্যু:

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত ১৬২৯ সাল থেকে ১৬৪৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর হল্যান্ডে ছিলেন! এরমধ্যে তিনি একবার অবশ্য ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে যান! তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালেই দর্শন চর্চা ও গ্রন্থ রচনা করেন।

দেকার্ত হল্যান্ডে থাকা কালীন সেখানকার প্রটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন! প্রটেস্টেন্টদের অভিযোগ ছিলো যে রেনে দেকার্ত নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। হল্যান্ডে নিয়োজিত, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত দেকার্তকে রক্ষা করেন!

এর পরে লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রেনে দেকার্তের উপর আবার অভিযোগ আনেন; তারা দেকার্তকে স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিংবা অনুকূল-প্রতিকূল সকল প্রকার মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে নিষেধ করে দেন! এক্ষেত্রে, প্রিন্স অব অরেঞ্জ দেকার্তকে সাহায্য করেন। সেখানে নিয়োজিত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ছিলেন দেকার্তের বন্ধু এই বন্ধুর মাধ্যমে সুইডেনের রাণী ক্রিশ্চিয়ানার সাথে দেকার্তের পত্র আদান-প্রদান শুরু হয়।

রাণী ক্রিশ্চিয়ানা দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। এক পর্যায়ে রাণী ক্রিশ্চিয়ানা ১৬৪৯ সালে অক্টবর মাসে দেকার্তকে আমন্ত্রণ জানান এবং দেকার্ত রাণীর আমন্ত্রণে সারা দিয়ে সুইডেনের স্টকহোমে চলে যান। এর পর রাণীর ইচ্ছা অনুযায়ী দেকার্ত রোজ ভোরে গিয়ে রাণীর প্রাসাদে রাণীকে দর্শন শিক্ষা দিতেন।

কিন্তু, রেনে দেকার্তের তো আবার দেড়ি করে ছাড়া, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার কোনো রকম অভ্যাস ছিলোনা! এজন্য শীতের মধ্যে রোজ রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাসাদে যাওয়ার কারণে দেকার্ত খুব অসুস্থ্য হয়ে পরেন! আর এই অসুস্থ্যতার কারনেই, মধ্যযুগীয় বিখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত ১৬৫০ সালের ফেব্রূয়ারি মাসে মারা যান।

  • সম্পূর্ন রেনে দেকার্তকে পড়ুন ইংরেজিতে – এখান থেকে দেকার্তের উপর ১৭ পৃষ্ঠার পিডিএফ ডাউনলোড করুন

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত সম্পর্কে প্রশ্ন-উত্তরঃ

১। প্রশ্নঃ দেকার্তের দার্শনিক চিন্তার মূল লক্ষ্য কি ? বা দেকার্তের মূল লক্ষ্য কি?
উত্তরঃ দার্শনিক সত্যতা লাভ করা। (বিচার, বুদ্ধি, চিন্তা ও বিশ্লেষনের মাধ্যমে দার্শনিক সত্যতা লাভ করাই দেকার্তের মূল লক্ষ্য।

২। প্রশ্নঃ তাঁর দার্শনিক উদ্দেশ্য কি?
উত্তরঃ এমন একটি সত্য বচন/ স্টেটমেন্ট রচনা করতে হবে যা হবে সন্দেহাতীত এবং সেই বচন হবে স্বতঃপ্রতীত।

৩। প্রশ্নঃ রেনে দেকার্তের দর্শনের মূল কথা কি?
উত্তরঃ পূর্ব ও ভ্রান্ত ধারণাকে সত্যের মানদন্ডে যাচাই করা ছাড়া তা গ্রহণ করা যাবে না। কোনো প্রকার সংস্কার ব্যতিত পূর্ব ধারণাকে গ্রহণ করা যাবেনা।

৪। প্রশ্নঃ রেনে দেকার্ত কোন ধরনের দার্শনিক ছিলেন?
উত্তরঃ রেনে দেকার্ত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ছিলেন।

৫। প্রশ্নঃ দেকার্ত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ছিলেন না কেনো ?
উত্তরঃ রেনে দেকার্ত মনে করতেন অভিজ্ঞতা আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয় না। অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ভূল হতে পারে। যেমন; একটি সোজা লাঠিকে অর্ধেক, পানিতে ডোবালে তা বাঁকা দেখায়! আবার আমরা অনেক সময় মাটিতে পরে থাকা দঁড়ি/রশিকে সাপ ভেবে ভূল করি ও ভয় পাই! এজন্য তিনি অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন না।

৬। প্রশ্নঃ দেকার্তের ৩টি উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম বলো ?

উত্তরঃ (১) ডিসকোর্স অন মেথোড – ১৬৩৭ সাল।
(২) দি মেডিটেশন অন দি ফার্স্ট ফিলোসোফি – ১৬৪১ সাল।
(৩) দি প্রিন্সিপাল অব ফিলোসোফি – ১৬৪৪ সাল।

৭। প্রশ্নঃ তিনি কি সন্দেহবাদী/ সংশয়বাদী দার্শনিক ছিলেন?
উত্তরঃ না। তিনি শুধু মাত্র দার্শনিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশয়বাদকে (skepticism) প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে নিয়েছেন।

৮। প্রশ্নঃ সব কিছুকে কি সন্দেহ করা যায় ? কাকে কাকে সন্দেহ করা যায়?

উত্তরঃ হ্যাঁ, সব কিছুকেই সন্দেহ করা যায়! রেনে দেকার্তের মতে, জগতের কিছুই সন্দেহর বাহিরে নয়। তাই, তার মতে সব কিছুর উপর সন্দেহ পোষন করা যায়! তার মতে, স্মৃতিকে সন্দেহ করা যায়। কারন, স্মৃতির মাধ্যমে আমারা সঠিকভাবে জ্ঞান লাভ করতে পারি না। স্মৃতি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান স্পষ্ট নয়! তাই স্মৃতি আমাদের সত্য ও সঠিক জ্ঞান দেয় না! যেমন, আমরা অনেক সময় অনেক কিছুই ভুলে যায়।

আবার কোনো ‍অনুমান বা কল্পনা থেকেও আমরা সঠিক জ্ঞান পাই না। তাই কল্পনাকেও সন্দেহ করা যায়! শুধু তাই নয়, দার্শনিক রেনে দেকার্তের মতে গনিতকেও সন্দেহ করা যায়। কারণ, গণিতেও ভুল থাকতে পারে; কিংবা আমরা ভুল শিখতে পারি। যেমন ২+২+৪ হয়, এটা কেউ হয়তো আমাদের বলে দিয়েছে। তা নাহলে ২+২=৫ হতে পারতো। এজন্য রেনে দেকার্ত বলেছেন গনিতকেও সন্দেহ করা যায়! রেনে দেকার্ত তো নিজের অস্তিত্বকেও সন্দেহ করেছেন। তাই বলা যায়, রেনে দেকার্তের মতে, কোনো কিছুই সন্দেহর বাহিরে নয়! সব কিছুকেই সন্দেহ করা যায়।

৯। প্রশ্নঃ দার্শনিক রেনে দেকার্তের সংশয়বাদ সম্পর্কে বলো?

উত্তরঃ রেনে দেকার্ত মনে করলেন যে, দার্শনিক সত্যতা যাচাই করতে হলে একটি মৌলিক পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে! এজন্য তিনি সংশয় পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন। তিনি মৌলিক সত্যকে আবিষ্কার কারার জন্য সংশয় পদ্ধতি বা সংশয়বাদের আশ্রয় নেন।

কিন্তু, তিনি সংশয়বাদী নন। দেকার্ত তার ডিসকোর্স অন মেথোড গ্রন্থে সংশয়বাদ নিয়ে আলোচনা করেছে! তিনি শুধু মাত্র প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে সংশয়বাদকে গ্রহন করেন। এর মাধ্যমে মন থেকে সমস্ত পূর্ব ও ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। তিনি এই সংশয়বাদকে গ্রহন করেছেন জ্ঞান ও সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠা করার জন্য! এভাবে তিনি সংশয় পদ্ধতি ব্যবহার করে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই সংশয়বাদ পদ্ধতি দেকার্তে সত্য প্রতিষ্ঠা করার একটি উপলক্ষ মাত্র!

তার মতে, কোনো বচন বা স্টেটমেন্ট কে প্রথমেই সত্য হিসেবে গ্রহন করা যাবে না। আগে সেটাকে সন্দেহ করতে হবে এবং সত্যের কষ্টি পাথরে যাচাই করতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংশয়বাদ পদ্ধতির মাধ্যমে সকল দার্শনিক মতবাদকে, ধর্মীয় কুসংস্কার, পূর্ব ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে বিশুদ্ধ করা যাবে।

১০। প্রশ্নঃ দেকার্তের সংশয়ের মাধ্যমে সত্যতা যাচাইয়ের ৪ (চারটি) টি পদ্ধতি কি কি?

উত্তরঃ (১) যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো বিচার্য বিষয় বা জাজমেন্ট সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল (clear and distinct) ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত না হয়, ততক্ষণ তাকে সন্দেহ করে যেতে হবে।
(২) কোনো জাজমেন্টের সত্যতা নিরুপন করার পূর্বে উক্ত বিষয়কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টে ভাগ করে নিতে হবে।
(৩) সরল থেকে শুরু করতে হবে এবং আস্তে আস্তে জটিল বা অজানার দিকে যেতে হবে। অর্থাৎ সহজ থেকে ক্রমান্বয়ে জটিলে প্রবেশ করতে হবে।
(৪) এমন ভাবে বিচার-বিশ্লেষন করতে হবে, যেনো কোনো কিছু বাদ না পরে যায়। কারন, কোনো কিছু বাদ পরলে, সত্য প্রতিষ্ঠিত নাও হতে পারে।

দেকার্ত তাঁর পদ্ধতির অনুসন্ধান এবং পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ (১৬৩৭), এবং ‘দি মেডিটেশনস’ (১৬৪৪) গ্রন্থে! যাতে তিনি দেখিয়েছেন ৫টি পথ ও পদ্ধতি। প্রথমত যুক্তির মহত্ত্ব। দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক নিয়মের অপরিবর্তনীয়তা। তৃতীয়ত দৈশিক বিস্তার এবং গতির তত্ত্বই হচ্ছে ভৌত বস্তুর মূল বৈশিষ্ট্য। চতুর্থত শরীর ও মনের পার্থক্য। পঞ্চমত বস্তুর কিছু গুণ সত্য এবং অন্তর্নিহিত। তার থেকে পৃথক হলো বস্তুর সেই সব গুণ, যা মনে হয় বস্তুতে আছে অথচ তা শুধুই মনের ওপর ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রতিক্রিয়া। দেকার্তের এই দার্শনিক মতামত আধুনিক চিন্তার ভিত্তি স্বরূপ।

১১। প্রশ্নঃ দার্শনিক রেনে দেকার্ত তিনি নিজেকে সন্দেহ করার মাধ্যমে কিভাবে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন?

উত্তরঃ জগতের সব কিছুকে যেহেতু আমরা সন্দেহ করতে পারি, তাই রেনে দেকার্ত মনে করলেন যে, আমাদের অস্তিত্বের উপরও সন্দেহ করা যায়! এভাবে দেকার্ত নিজের উপর সন্দেহ করেন। তিনি যে চিন্তুা করতে পারছেন, এই বিষয় টির উপর দেকার্তের কোনো রকম সন্দেহ রইলো না। কেননা, তিনি যেহেতু চিন্তা করতে পারছেন, তাহলে তার অস্তিত্ব রয়েছে।

যখন তিনি নিজের অস্তিত্বে সন্দেহ করছেন তখনও তিনি আছেন, আবার যখন সন্দেহ করছেন না তখনও তিনি আছেন, মানে তার অস্তিত্ব আছে। তার তিনি সন্দেহ করছেন মানে চিন্তা করতে পারছেন! অর্থাৎ সন্দেহ করার মাধ্যমেই চিন্তা ক্রিয়া টি সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। আর , আমি চিন্তা করতে পারছি, মানে আমার অস্তিত্ব রয়েছে। এজন্যই তিনি বলেন- “I think, therefore I exist“. আর এভাবেই রেনে দেকার্ত নিজেকে সন্দেহ করার মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন।

১২। প্রশ্নঃ সন্দেহ করাকে- সন্দেহ করা যায় কি না? কেনো ?
উত্তরঃ না। সন্দেহ করাকে- সন্দেহ করা যায় না! কারণ সন্দেহ করা একটা কাজ, সন্দেহ করাই চিন্তা করা। এভাবে, আমরা সন্দেহ করার মাধ্যমে চিন্তা করতে পারি! ঠিক এই কারণে, সন্দেহ করাকে সন্দেহ করা যায় না।

১৩। প্রশ্নঃ সত্য কেমন হবে?
উত্তরঃ এক কথায়, সত্য হবে – সুস্পষ্ট ও প্রঞ্জল (clear and distinct). অর্থাৎ সুস্পষ্ট ও প্রঞ্জলতা হলো সত্যের মানদন্ড।

১৪। প্রশ্নঃ কয়েকজন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকের নাম বলো।
উত্তরঃ রেনে দেকার্ত, স্পিনোজা ও লিবনিজ।

১৫। প্রশ্নঃ সংশয়বাদের বিপরীত কি?
উত্তরঃ
সংশয়বাদের বিপরীত হলো নির্বিচারবাদ। নির্বিচারবাদে কোনো কিছুকে বিচার বিশ্লেষণ না করেই গ্রহণ করা হয়! এজন্য নির্বিচারবাদ ও সংশয়বাদ পরস্পর বিপরীত।

১৬। প্রশ্নঃ সংশয়বাদী কাকে বলে?
উত্তরঃ
যিনি কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্য বা জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন তিনি সংশয়বাদী। (রেনে দেকার্ত কিন্তু সংশয়বাদী নন।)

১৭। প্রশ্নঃ সংশয়বাদ সম্পর্কে সমালোচদের সমালোচনা কি ছিলো? I think, therefore I exist সমালোচনা কি ছিলো?
উত্তরঃ
রেনে দেকার্তের মতে, I think, therefore I exist, এটা একটি সিন্থেটিক জাজমেন্ট। কিন্তু, সমালোচকদের মতে এটা সিন্থেটিক নয়, এটা অ্যনালিটিক স্টেটমেন্ট। কারণ, এটা নতুন কোনো তথ্য দিচ্ছে না।

রেনে দেকার্ত তার নিজের অস্তিত্ব প্রমানের জন্য, নিজের চিন্তন ক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছেন! আর এজন্য তিনি বলেছেন- I think, therefore I exist. কিন্তু, চিন্তা ক্রিয়াকে প্রাধন্য দেয়া যায় না। যেমন; হাঁটা, খাওয়া, চলা, কথা বলাও তো ক্রিয়া। তাহলে তো বলা যাবে যে- আমি খাই, সুতরাং আমি অস্তিত্বশীল!!

১৮। প্রশ্নঃ রেনে দেকার্ত মোট কত টি দ্রব্যর কথা বলেছেন।
উত্তরঃ
প্রথমত দেকার্ত- ঈশ্বর, দেহ এবং মন এই ৩ টির কথা বলেছেন।

১৯। প্রশ্নঃ দার্শনিক দেকার্ত দ্রব্য কে কয় ভাগে ভাগ করেন?

উত্তরঃ দেকার্ত দ্রব্যকে ২ ভাগে ভাগ করেন। (১) ঈশ্বর, (২) দেহ-মন।

২০। প্রশ্নঃ ঈশ্বর কোন ধরনের দ্রব্য?
উত্তরঃ
ঈশ্বর হলেন পরম দ্রব্য। ঈশ্বর হলেন নিরপেক্ষ।

২১। প্রশ্নঃ দেহ-মন কোন ধরনের দ্রব্য?
উত্তরঃ
দেহ-মন হলো ক্রিয়েটেড দ্রব্য।

২২। প্রশ্নঃ ঈশ্বরের সৃষ্ট দ্রব্য কয়টি ও কি কি?
উত্তরঃ
ঈশ্বরের সৃষ্ট দ্রব্য ২ টি।

  1. কর্পোরেল (জড় , যেমন দেহ)
  2. আধ্যাত্মিক (মন, আত্মা)

২৩। প্রশ্নঃ দেহ-মনের বা জড়-চেতনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ্য করো?
উত্তরঃ
১. মন হলো বিস্তারহীন চেতনাযুক্ত।
২. জড় হলো চেতনাহীন বিস্তৃত দ্রব্য।
৩. জড়ের ধর্ম হলো বিস্তার করা। জড় বিস্তার করবে!
৪. চেতনা বা মনের ধর্ম হলো চিন্তা করা।
৫. দেহ-মন পরস্পর বিপরীত।

২৪। প্রশ্নঃ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্তের দ্বৈতবাদ বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ব্যাখ্যা করো?

উত্তরঃ দেহ এবং মন হলো দুটি পরস্পর বিরোধী সতন্ত্র দ্রব্য। দেহ হলো জড় বা যান্ত্রিক! দেহর বিস্তার বা স্থান ব্যাপ্তি রয়েছে। আর মনের উদ্দেশ্য রয়েছে! সুতরাং, এই দুটি পরস্পর বিপরীত। এতে প্রমান হয়, দেহ এবং মন পৃথক ও সতন্ত্র। কিন্তু, আমরা প্রকৃতিতে দেখি যে, দেহ এবং মন এক সাথে থাকে ও ক্রিয়া করে। যেমন; দেহ অসুস্থ্য হলে মন খারাপ লাগে! আবার মন খারাপ হলেও দেহের উপর খারাপ প্রভাব পরে।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে দেহ ও মন সতন্ত্র হলেও, দেহ ও মনের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক রয়েছে! অর্থাৎ দেহ-মন পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। মন, দেহের উপর এবং দেহ, মনের উপর ক্রিয়া করে। মস্তিষ্কে অবস্থিত পিনিয়াল নামক এক গ্রন্থির মাধ্যমে দেহ-মনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়! এভাবে উয়য়ের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে! এই প্রক্রিয়াকে রেনে দেকার্ত নাম দিয়েছেন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াবাদ। এটাকে দৈত্যবাদও বলা হয়।

এই ক্রিয়া -প্রতিক্রিয়া কার্যকারনের ফল। অর্থাৎ দেহ – মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কার্যকারনের মাধ্যমে ঘটে।

২৫। প্রশ্নঃ কার্যকারণ কাকে বলে?
উত্তরঃ
জগতের কোনো কাজই কারণ ছাড়া বা উদ্দেশ্য ছাড়া ঘটে না। প্রত্যক কাজের পেছনেই কারণ থাকে। অ্যারিস্টটলের মতে, কারন মোট ৪টি। যথা; ১. উপাদান কারন, ২. রুপগত কারন; ৩. পরিণতি কারন, ৪. নিমিত্ত কারন।

২৬। প্রশ্নঃ রেনে দেকার্ত মানুষের মনের মধ্যে কত ধরনের ধারণার কথা বলেছেন? বাখ্যা করো।

উত্তরঃ ৩ ধরনের ধারনার কথা বলেছেন।

(১) কৃত্রিম ধারণা: কৃত্রিম ধারণা হলো মিথ্যা ধারণা। যেমন, কল্পনার মাধ্যমে পাওয়া ধারণা হলো কৃত্রিম ধারণা। যেমন- পাঙ্কীরাজ ঘোড়ার ধারনা হলো কৃত্রিম ধারণা। কারন- বাস্তবে এই পঙ্কীরাজ ঘোড়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই এটা কৃত্রিম ধারনা।

(২) আগন্তুক ধারণা: বাহিরে থেকে বা বাহিরে অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ধারনা হলো আগন্তুক ধারনা। এই ধরনার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ধারনা ভূল হতে পারে।

(৩) সহজাত ধারণা: জন্মের পরে সহজাত ভাবে বা জন্ম সূত্রে পাওয়া ধারনা হলো সহজাত ধারনা। দেশ, কাল ভেদে সহজাত ধারনা একই থাকে। ঈশ্বরের ধারণা হলো সহজাত ধারনা।

২৭। প্রশ্নঃ মানুষের মনের ৩টি ধারণার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধারণা কোনটি?
উত্তরঃ
সহজাত ধারণা।

২৮। প্রশ্নঃ দেকার্তের ঈশ্বরের ধারণা কোন পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত?
উত্তরঃ
দেকার্তের ঈশ্বরের ধারণা কার্যকারন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

২৯। প্রশ্নঃ দেকার্ত কিভাবে প্রমাণ করেন যে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল বা ঈশ্বর রয়েছেন?

উত্তরঃ রেনে দেকার্ত কার্যকারন পদ্ধতির মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করেন। যেমন তিনি বলেছেন; আমরা সসীম। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেহেতু আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে; তাই আমরা ঈশ্বরের কারন হতেই পারি না। কেনন ঈশ্বর হলেন অনন্ত, তিনি অসীম। আর সসীমের পক্ষে অসীমের কারণ হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং, আমরা ঈশ্বরের কারন নই! তাহলে, আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের ধারনা এলো কি কারনে?

তাহলে, ঈশ্বর নিজেই আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের ধারনা দিয়েছেন! ঈশ্বরই আমাদের মধ্যে সহজাত ধারনা দিয়েছেন! সুতরাং, ঈশ্বর রয়েছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে! অর্থাৎ ঈশ্বর নিজেই নিজের কারন। সুতরাং কার্যকারন পদ্ধতির আলোকে বলা যায় ঈশ্বর রয়েছেন।

৩০। প্রশ্নঃ আমরা কি নিজেরা নিজেদের কারণ হতে পারি ? ব্যাখ্যা করো?
উত্তরঃ
না। আমরা সসীম। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেহেতু আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে; তাই আমরা নিজেদের কারন হতে পারি না।

৩১। প্রশ্নঃ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে অনটোলোজিক্যাল যুক্তি কি?
উত্তরঃ
দেকার্তের মতে, আমাদের মধ্যে পূর্নতার ধারণা রয়েছে। আর আমাদের মনের মধ্যে ঈশ্বরের ধারণা সবচেয়ে পূর্ণ! ঈশ্বরের ধারনা সবচেয়ে বড় ধারনা, এর থেকে বড় ধারনা আর কিছু হতে পারে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে, কখনোই ঈশ্বর পূর্ণ হতে পারে না।

আর যেহেতু ঈশ্বর পরিপূর্ণ, সুতরাং পুরিপূর্ণ সত্ত্বা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। এভাবে অনটোলোজিক্যাল যুক্তির মাধ্যমে বলা যায় যে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।

৩২। প্রশ্নঃ দার্শনিক রেনে দেকার্তের ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে বিপরীতে সমালোচনা কি ছিলো?

উত্তরঃ অভিজ্ঞতাবাদীরা বলেন যে- অসীমের ধারনা একটি নেগেটিভ ধারানা। কারণ অসিমের ধারণা হলো অস্পষ্ট। অসিমকে আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাইনা। তাই অসিমের ধারণা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে পারে না।

৩৩। প্রশ্নঃ দেকার্ত যেভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে- তা চক্রদোষে দুষ্ট কেনো?
উত্তরঃ
দেকার্ত প্রথমে আমাদের চেতনার মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব প্রমান করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন- আমি চিন্তা করতে পারি, তাই আমি আছি। আমরা সসীম, তাই আমরা আমাদের সৃষ্টির কারণ হতে পারি না। তাহলে আমাদের চেতনায় ঈশ্বরের ধারণার ঈশ্বর দিয়েছেন। আর আমরা তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের কারণ নই। তাহলে ঈশ্বর নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারন। তাই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল। আর ঈশ্বরই সব কিছুর কারন। তাহলে তো ঈশ্বর চেতনারও কারন।

সুতরাং- দেকার্ত, চেতনার সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করলেন, আবার, ঈশ্বরের সাহায্যে চেতনার প্রমান করলেন। এজন্য একে চক্রদোষে দুষ্ট বলা হয়েছে।

৩৪। প্রশ্নঃ দ্রব্য ও দ্রব্যর গুণ সম্পর্কে দেকার্ত কি কি বলেছেন?
উত্তরঃ
দ্রব্য বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর গুণ। গুণ ছাড়া কোনো দ্রব্যকে চিন্তাও করা যায় না। কোনো দ্রব্যর আবশ্যিক গুন হলো এর মুখ্য গুন। যেমন; টেবিলের ৪ টি পা থাকে। এটা হবে টেবিলের মুখ্য গুন। আর কোনো টেবিল রং করা নাও থাকতে পারে- এধরনের গুন গৌণ গুন।

৩৫। প্রশ্নঃ দেহ-মনের ধর্ম কি এবং এর সমালোচনা কি ছিলো?

উত্তরঃ মনের ধর্ম হলো চিন্তা করা। অপর দিকের দেহের ধর্ম হলো বিস্তার বা স্থান দখল করা। দেকার্তের মতে দেহ এবং মন হলো ক্রিয়েটেড দ্রব্য। দেকার্তের মতে দেহ- দুটি আলাদা, এরা সতন্ত্র। তিনি বলেন যে- দেহ মন আলাদা হলেও, দেহ ও মনের মধ্যে একটি সু-সম্পর্ক রয়েছে! অর্থাৎ দেহ-মন পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল! মন দেহের উপর এবং দেহ মনের উপর ক্রিয়া করে! মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিত পিনিয়াল নামক এক প্রকার গ্রন্থির মাধ্যমে দেহ এবং মনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়! এভাবে ঈশ্বরের মাধ্যমে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে! এই প্রক্রিয়াকে রেনে দেকার্ত নাম দিয়েছেন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াবাদ। এটাকে দৈত্যবাদও বলা হয়।

কিন্তু, সমালোচকরা বলেন; দেহ ও মন ভিন্ন ধর্মী নয়। এরা একই। এদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। সমালোচকদের মতে; দেকার্তের এই নীতি, শক্তির নীতিকে লঙ্ঘন করে। কারন; মানসিক শক্তি, দৈহিক বা দেহ শক্তির উপর ক্রিয়া করলে, মানসিক শক্তির হ্রাস বা ক্ষয় হয়। তাই, দেকার্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের মাধ্যমে শক্তির নিত্যতা নীতি লঙ্ঘন হয়।

৩৬। প্রশ্নঃ উপলক্ষবাদ অনুসারে ঈশ্বর কিভাবে দেহ-মন কে পরিচালনা করেন?
উত্তরঃ
উপলক্ষবাদ অনুসারে ঈশ্বর দেহ ও মনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দেন। অর্থাৎ ঈশ্বরের মাধ্যমে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। দেহের প্রয়োজনে মনের এবং মনের প্রয়োজনে দেহের পরিবর্তন ঘটে।

৩৭। প্রশ্নঃ উপলক্ষবাদের সমালোচনা কি?

উত্তরঃ অনেকেই এই উপলক্ষবাদকে গ্রহন করেননি। তারা মনে করেন, সমস্যা সমাধানের জন্য এখানে ঈশ্বরকে আনা হয়েছে। যেটা মোটেই অনুচিত।

৩৮। প্রশ্নঃ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত কিভাবে নিজের অস্তিত্বকে প্রমান করেন?
উত্তরঃ
বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত সব কিছুকেই সন্দেহ করেছেন। তিনি নিজেকেও সন্দেহ করে বসেন! এর পরে তিনি দেখলেন যে, তিনি চিন্তুা করতে পারছেন। যেমন সন্দেহ করাও একটি চিন্তা। আর তাই তিনি বললেন- I think, therefore I exist. এভাবে রেনে দেকার্ত নিজের আত্মসত্তাকে প্রমান করেন।

৩৯। প্রশ্নঃ দর্শনে রেনে দেকার্তের অবদান বর্ণনা করো।

উত্তরঃ আধুনিক দর্শনে রেনে দেকার্তের অবদান অবিস্মরনীয়। নিম্নলিখিত ভাবে দার্শনিক রেনে দেকার্তের অবদান উল্লেখ করা হলো:

  1. দেকার্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং অস্তিত্ব প্রমান করেছেন।
  2. দ্রব্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।
  3. রেনে দেকার্ত সকল প্রকার ভ্রান্ত ধারনা থেকে দর্শনকে মুক্ত করেন।
  4. তিনি চেতনা থেকে যাত্রা করেন। এজন্য তিনি বলেন “ আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’’।
  5. দেহ ও মন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ব্যাখ্যা করেন।
  6. আমাদের ধারনা নিয়ে আলোচনা করেন।
  7. ফরাসি বিপ্লবের পেছনে রেনে দেকার্তের ডিসকোর্স অন মেথড বইয়ের ভূমিকা ছিলো।
  8. দেকার্ত পূর্ব কোনো ধারনাকে গ্রহন করেননি। এজন্য তাকে আধুনিক দর্শনের জনক বলা যায়।
  9. দেকার্ত, নিজের আত্ম-সত্ত্বার প্রমাণের মাধ্যমের দর্শনে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেন।
  10. সত্যের মানদন্ড হিসেবে সুস্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতার (clear and distinct) কথা বলেছেন।

৪০। প্রশ্নঃ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত কখন মারা যান?
উত্তরঃ শীতে অসুস্থ্য হয়ে ১৬৫০ সালের ফেব্রূয়ারি মাসে তিনি মারা যান।

Leave a Comment